-->
শিরোনাম

রাজপথ দখলে মরিয়া বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম
রাজপথ দখলে মরিয়া বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম: বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপি এখন রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া। পুলিশের হয়রানি, গ্রেপ্তার ও সরকারি দলের বাধার অভিযোগসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে দলটি এখন মাঠে। দ্রুত সময়ে সব প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে সরকার পতনের এক দফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির।

 

সর্বোচ্চ আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের পাতানো ফাঁদে পা না দিতেও দলের নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছে হাইকমান্ড। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে দলটির আন্দোলনে সক্রিয় নেতারা এখন মাঠে।

 

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে সবাই এখন আন্দোলনে। বর্তমান সরকারের পদত্যাগের বাইরে কিছু ভাবছেন না তারা। আন্দোলনে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের বাধা শেষ পর্যন্ত তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। দমন-পীড়নে আন্দোলনে গতি বাড়বে বলেও দাবি তাদের।

 

আর তৃণমূল বলছে, অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার কেন্দ্র জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে অটুট। তাই তাদের বৃদ্ধি পাওয়া মনোবল ধরে রাখতে কেন্দ্রকে সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত দৃঢ় থাকতে হবে।

 

জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বাকি প্রায় ৮ মাস। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখন রাজনীতির মাঠ সরগরম। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি এখন রাজপথে। দলটি এবার রমজান মাসেও মাঠের কর্মসূচিতে ছিল। মাঝে বেশ কিছুদিন আন্দোলনের ছন্দপতনের পর দলটি এখন আবারো লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে।

 

গত এক সপ্তাহজুড়ে দলটি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে। এ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পটুয়াখালী, খুলনা, রাজবাড়ী, নেত্রকোনা ও ফেনীসহ বেশ কয়েক জায়গায় বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পদযাত্রায় রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে পুলিশ ও বিএনপির সংঘর্ষ হয়।

 

প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আটক করা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। গত কয়েকদিনে বিএনপি মাঠে নামার শুরুর দিকে কিছুটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করলেও ক্রমেই রাজনীতির মাঠ অশান্ত হয়ে উঠছে।

 

সম্প্রতি রাজশাহী জেলা বিএনপির আহব্বায়ক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির অভিযোগে রাজনীতি আরো জটিল পরিস্থিতির দিকে গেছে। খোদ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখন থেকে আর শান্তি সমাবেশ নয়, বিএনপিকে প্রতিরোধ করা হবে। ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

 

আবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, রাজশাহীর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ গরমের কৌশল নিয়েছে। কোনো হুমকি-ধমকিতে তারা মাঠ ছাড়বেন না।

 

একদিকে পুলিশের বাধা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মধ্যে বিএনপির যে মাঠে টিকে থাকা সহজ হবে না, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

 

বিএনপির তৃণমূলের নেতারা বলছেন বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দাবি আদায়ে বিএনপি এখন দৃঢ়ভাবে মাঠে। তৃণমূলে বিএনপির আন্দোলনের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে দলের কমিটমেন্ট থাকতে হবে দৃঢ়। তারা মনে করছেন, অতীতে তারা কঠোর আন্দোলন করেও ঘরে ফল তুলতে পারেননি।

 

কারণ হিসেবে তারা দলের হাইকমান্ডকে দায়ী করেছেন।

 

তারা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহতে সব ধরনের আন্দোলন করেছিল তৃণমূল। কিন্তু ঢাকার নেতারা আন্দোলনে কোনো ভ‚মিকা রাখতে পারেনি। বিএনপির আন্দোলনে ওই সময় সারা দেশ অনেকটা অচল থাকলেও ঢাকা ছিল স্বাভাবিক। আবার ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনকে ‘ইমাম’ মেনে নির্বাচনে যাওয়া ছিল আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত।

 

এবার দল আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে ‘গোলপোস্ট’ ঠিক করে আন্দোলন করছে। তাই সফল না হওয়ার কোনো কারণ তারা দেখেন না। আন্দোলন শুরু করলেও বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রলোভনে সরকার ‘নানা টোপ’ দিতে পারে বলেও তৃণমূলের আশঙ্কা রয়েছে।

 

কোনো টোপে পা না দিয়ে ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার কঠোর সিদ্ধান্তে দলের প্রতি আস্থা বেড়েছে। ইতোমধ্যে তৃণমূল কঠোরভাবে মাঠে নেমেছে বলেও দাবি তৃণমূল নেতাদের।

 

যশোরের মনিরামপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সদস্য নিস্তার ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, গত ১০ দিন তিনি রাতে বাড়িতে থাকেন না। কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। প্রতিদিন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে নেতাকর্মীদের।

 

তার দাবি, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করে আন্দোলন দমানো যাবে না। বরং গতি আরো বাড়বে। দলের হাইকমান্ড অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণের কাছে দেয়া কমিটমেন্ট পূরণে বর্তমানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দল এখন দৃঢ়। তার বড় উদাহরণ বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়া। দলের এ ধরনের অবস্থানে নেতাকর্মীদের মাঝে মনোবল বেড়েছে।

 

ফলে আগামীতে সব বাধা পেরিয়ে তারা রাজপথে থাকতে পারবেন বলেও তার আশা। এত বাধার পরেও বর্তমানে সব কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি তার প্রমাণ বহন করে বলে দাবি নিস্তার ফারুকের।

 

যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু যশোরের রাজনীতির মাঠের চিত্র তুলে ধরেন।

 

তিনি বলেন, আগামী ২৭ মে যশোরে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে মঙ্গলবার যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন ঘোষণা দিয়েছেন যশোর বিএনপিকে সভা করতে দেয়া হবে না। একইসঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাথা ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন মিলন।

 

কিন্তু তার এই হুমকিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিচলিত নয়। যশোরে যেকোনো উপায়ে ২৭ তারিখে সমাবেশ করা হবে বলেও জানান তিনি।

 

তিনি বলেন, ইতোপূর্বে জেলা আওয়ামী লীগ বাধা দিয়েও যশোরে সমাবেশ ঠেকাতে পারেনি।

 

সাবু বলেন, নেতাকর্মীরা হামলা মামলার শিকার হয়ে এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে, তারা আর কোনো হুমকিতে বিচলিত হন না। নেতাকর্মীদের এই মনোবল সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা আনবে বলেও মনে করেন তিনি।

 

এছাড়া সাতক্ষীরা, সিলেট ও বগুড়ার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

 

তারা বলছেন, দলের লক্ষ্য এবার অটুট। তাই এবার সব বাধা পেরিয়ে তারা এক দফার আন্দোলনে রাজপথে থাকবেন।

 

তারা আরো বলেছেন, বর্তমান সরকারকে এবার ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলে তাদের নামে থাকা অসংখ্য মামলারও বিচার শেষ করা হবে। তাদের জেল-জরিমানা হয়ে যাবে। এটিও তাদের মাথায় আছে।

 

এদিকে দীর্ঘদিন থেকে ব্যর্থতার অভিযোগে কাঠগড়ায় থাকা ঢাকা মহানগর বিএনপি এবার সফলতা আনতে তৎপর। দলটির মহানগরের একাধিক নেতা বলেছেন, এবার তারা দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঢাকায় কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। তাই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ঢাকা মহানগরে। বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা এখন মাঠের কর্মসূচিতে তৎপর। সম্প্রতি এই দুই শাখার সভা-সমাবেশে জনসমাগমও চোখে পড়ার মতো।

 

জানা গেছে, আগামীতে এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার আগে গত দুই মাসে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বেশ কয়েকজন নেতা।

 

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়া একাধিক নেতা ভোরের আকাশকে বলেছেন, আগামীর আন্দোলনে বিশেষ নির্দেশনা দিচ্ছেন তারেক রহমান। আগামীতে মাঠে টিকে থাকার নানা কৌশল ও করণীয় নিয়েও তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। দলের হাইকমান্ডের কথা যেন নেতা সর্বোচ্চভাবে মাঠে বাস্তবায়ন হয়, সে ব্যাপারে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন।

 

বিশেষ করে বিগত দিনে ‘ঢাকা মহানগরী’তে আন্দোলনের ব্যর্থতার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেটিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এক দফার আন্দোলনে ‘ঢাকাকে কেন্দ্রবিন্দু’ করে তার স্পষ্ট বার্তাও নেতাদের জানাচ্ছেন। এছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে যেন কোনো অবস্থাতে কেউ নির্বাচনে যাওয়ার চিন্তা না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন তিনি।

 

সূত্র বলছে, আস্থা রাখার ক্ষেত্রে তারেক রহমান ছাত্রদল বা ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা নেতাদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। ওইসব নেতারা এখন দলে মধ্যম সারির নেতা হিসেবে পরিচিত। তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা সর্বত্র পৌঁছানো এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। কোনো অবস্থাতে তারা এবার ব্যর্থতার দায় নিতে চান না।

 

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহব্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, আগামীদিনের আন্দোলনে তারা ঢাকায় কঠোরভাবে মাঠে থাকবেন। ইতোমধ্যে তার প্রমাণ মিলেছে বলেও দাবি তার। অতীতে ব্যর্থতার প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, অতীতেও চেষ্টার ঘাটতি ছিল না। তবে এবার নতুন কৌশলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় তারা কাজ করছেন।

 

এদিকে, সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তিতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন! এমন গুঞ্জন এখন রাজনীতির মাঠে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদের পর থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতাসহ বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আছেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিষয়টি আরো ডালপালা গজাচ্ছে। আগামীদিনের আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে তিনিও নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

 

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ শেষে বলেছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ে দেশের মানুষকে আন্দোলনে শরিক হতে বলেছেন খালেদা জিয়া। তার বক্তব্যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার নির্দেশনার প্রমাণ বহন করে। যদিও বরাবরই বিএনপি খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন দেশের মানুষকে বাঁচাতে বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রামে আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্রের মুক্তি ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে সব ধরনের আন্দোলন করা হবে বলেও জানান তিনি। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এটি এখন দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উচ্চারিত হচ্ছে। অচিরেই এক দফার আন্দোলন আসছে।

 

দলটির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, বিএনপি এখন মাঠের কর্মসূচিতে। সঠিক সময়েই দল এক দফা আন্দোলনে যাবে। দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি। ধরপাকড় করে আন্দোলনের গতি কমে যাওয়ার পরিবর্তে বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version