নিখিল মানখিন: বিদ্যমান সংবিধান মেনেই বিএনপিকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল।
তারা বলছেন, বিদেশি কূটনীতিকদের অবস্থান এবং নতুন মার্কিন ভিসানীতির কোথাও বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে বিরোধিতা নেই। মার্কিন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে আওয়ামী লীগ। বিপাকে পড়েছে বিএনপি। ভিসানীতি স্বাগত জানালেও নিজেদের এক দফা আন্দোলন অব্যাহত রাখার যৌক্তিকতা হারিয়েছে দলটি। কারণ তাদের এক দফা আন্দোলন ও বিদ্যমান সংবিধান সাংঘর্ষিক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর পাল্টে যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক চিত্র। বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। নতুন কৌশল সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছে রাজনৈতিক দলগুলো।
গত ৩ মে মধ্যরাতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সহায়তার জন্য নতুন এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্রিংকেন।
অ্যান্টনি ব্রিংকেন প্রথমে টুইট করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে এ বিষয়ে তার বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। বিষয়টি এ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যসহ গণমাধ্যম, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক পাড়া তথা সমগ্র দেশের আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেকেই সামাজিকমাধ্যমে নিজেদের মতো করে নীতিটির ব্যাখ্যা করছেন, যা আবার জনমনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
নতুন মার্কিন ভিসানীতি: ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী এই ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং এক্ষেত্রে তারা পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
মার্কিন দপ্তরের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছেন। এই নীতিটি সেই প্রচেষ্টাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করার জন্য প্রণীত হয়েছে।
নতুন এই ভিসানীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্তমান বা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি নির্বাচনে বাধাদানকারীর পরিবারের নিকটতম সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত।
কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয় বরং দলমত নির্বিশেষে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এমন কর্মকান্ডে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি এই বিধিনিষেধের আওতাধীন থাকবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
বিপাকে বিএনপি, প্রশান্তিতে আওয়ামী লীগ: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সরকারি ও বিরোধী দলের যে কেউ ভিসানীতি লঙ্ঘনে অভিযুক্ত হতে পারেন। ফলে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। যেহেতু নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ভিসানীতির বাইরে সেহেতু প্রশান্তিতে রয়েছে আওয়ামী লীগ। মার্কিন ভিসানীতি স্বাগত জানিয়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে, সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিদ্যমান সরকারই নির্বাচনের সময় চলমানভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এ সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা করবে।
তাদের মতে, উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তাই সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে রাজপথেই তাদের মোকাবিলা করা হবে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি সরকার বারবার সংবিধানের ওপর আঘাত হেনেছে। তারা সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
তাই সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে রাজপথেই তাদের মোকাবিলা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি বার্তা উচ্চারণ করে রেখেছেন ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগকে চাপে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপি। সরকার পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে এক দফা আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
তার মধ্যে ঘোষিত হয়েছে নতুন মার্কিন ভিসানীতি, যেখানে সরকার পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ বিদ্যমান সংবিধানবিরোধী কোনো বক্তব্য নেই। ফলে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি কূটনীতি এবং নতুন মার্কিন ভিসানীতি সাংঘর্ষিক নয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে এক দফা আন্দোলন বাস্তবায়নে অনড় রয়েছে বিএনপি।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। অতীতে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, আগামীতেও হবে না।
সেজন্য বিএনপি তার অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আজ আন্তর্জাতিকভাবেও দাবি উঠেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। বিএনপিসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনরত কোনো দল হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়েছেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
এর আগে গত ২০ মে লালমনিরহাটের এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০ দফা নয়, দাবি একটাই শেখ হাসিনার পদত্যাগ। দফা এক শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এ দাবি শুধু আমাদের নয়, দেশের জনগণেরও। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না। তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠনের পাশাপাশি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে নীরব বিদেশি কূটনীতিকরা: বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা ও আলাপচারিতায় মুখর দেশের রাজনীতির মাঠ। পাশাপাশি ঘোষিত হয়েছে নতুন মার্কিন ভিসানীতি। সব মিলিয়ে বিশ্ব ব্যাপী আলোচনায় রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি উঠে আসছে বিদেশি কূটনীতিকদের আলাপচারিতায়।
কিন্তু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কোনো কথা বলছেন না তারা। শর্ত মেনে নিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে এমন শর্ত বা পরামর্শ থাকছে না তাদের আলাপে। অর্থাৎ নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ও দায়িত্ব পালনেই সীমাবদ্ধ রাখছেন কূটনীতিকরা। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপিকে পেতে আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে তৎপর বিএনপি। বিভিন্ন কৌশলে আন্তর্জাতিক মহলের বিবৃতি প্রদানে সফলতাও পেয়েছেন তারা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কূটনীতিকদের নীরবতায় হতাশ তারা।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি সরকার বারবার সংবিধানের ওপর আঘাত হেনেছে। তারা সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা করলে রাজপথেই তাদের মোকাবিলা করা হবে বলে জানান সুজিত রায় নন্দী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার ভোরের আকাশকে বলেন, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি সরকার ও বিরোধীদলের সকলের জন্যই প্রযোজ্য। তবে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি দায় থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ভিনা নীতির বিষয়টি বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার কৌশলও হতে পারে। ভিসা নীতি অনুযায়ী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তবে তিনি বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না আসার বিষয়ে অনড় রয়েছে বিএনপি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য