মনস্তাত্ত্বিক চাপে বড় দুই দল

নিখিল মানখিন
মনস্তাত্ত্বিক চাপে বড় দুই দল

নিখিল মানখিন: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রয়েছে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিদেশি কূটনীতিকদের কথাবার্তা এবং আচরণও দুই দলকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রেখেছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসম্মুখে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করলেও বির্ভিন্ন সময়ে দুই দলের নেতাদের বক্তব্যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ফুটে উঠছে। রাজনীতিতে বিরাজ করছে গুমোট পরিস্থিতি।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল নানা কারণে মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ছয় মাস বাকি। আসছে সেপ্টেম্বরে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারদলীয় মন্ত্রীরা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেও নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক জটলা ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ।

 

বিএনপির মনস্তাত্ত্বিক চাপ: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার পতনের এক দফা দাবি বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছে বিএনপি। আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা বিএনপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মামলা-হামলা মোকাবিলা করে সফলভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিত করা, সহিংসতা এড়িয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কী হবে সেসব দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন নিয়ে সুবিধা করতে পারছে না বিএনপি।

 

সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার সফলতার বিকল্প ভাবছে না বিএনপি। দাবি আদায় হলে দ্বিতীয় পর্বে দলটির সামনে আরের কিছু কঠিন বিষয় আসবে। সেগুলোর মধ্যে আছে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আসন ভাগাভাগি, যোগ্যদের মনোনয়ন দেয়া এবং নির্বাচনে জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের সরকার গঠন।

 

তবে কোনো কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হলে দলটি নতুন করে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রতিহত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপরও সরকার নির্বাচন করে পার হয়ে গেলে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপিকে টিকিয়ে রাখাই হবে তখন তাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, শুধু বিএনপি নয় জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক বিষয়ই সহজ হয়ে যাবে।

 

আসন ভাগাভাগি, মনোনয়ন কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়ে জটিলতা হবে না।

 

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রয়োজন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দেশে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কাজ করছি। এছাড়া দলীয় কিছু চ্যালেঞ্জ তো সব সময়ই থাকে। সেগুলোকে আমরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। দলীয়ভাবেই তা সমাধান করা হয়ে থাকে।

 

আওয়ামী লীগের মনস্তাত্ত্বিক চাপ: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির তুলনায় বেশি মনস্তাত্তি¡ক চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন টানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটির তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। তাদের আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর।

 

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমেরিকার নতুন ভিসানীতি। নির্বাচনী বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে দলটিকে। সুরাহা দিতে হবে দলীয় তৃণমূল কোন্দলের।

 

গত ৫ মে গণভবনে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে চ্যালেঞ্জসমূহ এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ হবে।

 

কারণ, বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্র রয়েছে। যখনই দেশের মানুষের জীবনযাত্রার কিছুটা উন্নতি হয়, তখনই বাংলাদেশে কিছু কুলাঙ্গার আছে, যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং সর্বত্র মিথ্যাচার করে।

 

শেখ হাসিনা বলেন, কিছু মানুষ আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার জন্য বিদেশিদের সামনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার অঙ্গীকার রক্ষা করেছে, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম, পরিবহন খরচ, গ্যাস, জ্বালানি ও কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

 

তিনি আরো বলেন, বৈদেশিক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্র্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। তবে এখনো পাঁচ মাসের খাদ্য সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট রিজার্ভ মজুত রয়েছে। সারাবিশ্বে এবং বাংলাদেশেও খাদ্যের দাম বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জনগণের কষ্ট হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক চাপে পড়েছে আওয়ামী লীগ। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান সরকারবিরোধী আচরণ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। নির্বাচনমুখী হলেও বিরাজ করছে দলীয় তৃণমূল কোন্দল। মারমুখী বিএনপির চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছে দলটি।

 

১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। শরিক দলের অনেক নেতাকে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতেও দেখা যাচ্ছে। ভোটের আগে আসন ভাগাভাগিসহ কয়েকটি ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে ঐক্য আনার কাজটিও রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে।

 

পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন সফল করার তীব্র চাপে রয়েছে বিএনপি। কিন্তু দেশব্যাপী জোরালো আন্দোলন করতে পারছে না তারা। কর্মসূচি দিলেই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে তা প্রতিহত করা হচ্ছে। মামলা-হামলার শিকার হয়ে এলাকাছাড়া হয়ে পড়ছেন বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের বক্তব্য ও আচরণ বিএনপির জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত কোনদিকে মোড় দেবে তা নিয়েও চাপে রয়েছে দলটির হাইকমান্ড।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য