-->

সংলাপের আলোচনাকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম
সংলাপের আলোচনাকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা মন্ত্রীদের বক্তব্যকে ফাঁদ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটি এ আলোচনার ব্যাপারে কোনো সায় দিচ্ছে না। বর্তমান সরকারের পদত্যাগের আগে কোনো আলোচনায় বসতেও রাজি নন বিএনপি নেতারা।

 

এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেয়ায় বিএনপি এটিকে কোনোভাবেই আমলে নিচ্ছে না।

 

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি এখন সবচেয়ে বড় চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় সরকার এখন নাটকীয়ভাবে দেখাতে চাইছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ক্ষমতাসীনরা আন্তরিক।

 

এছাড়া চলমান আন্দোলনও ভিন্ন খাতে নিতে এটি সরকারের অপকৌশল বলেও মনে করছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

 

২০১১ সালের ১০ মে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান সংবলিত সংবিধান সংশোধনীকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে এটি বাতিল করে। পরবর্তীতে ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল।

 

এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংকট শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। আর বিএনপি তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়। দাবির পক্ষে দলটি লাগাতার হরতাল-অবরোধ শুরু করে। সংকট নিরসনে শুরু হয় দেশি-বিদেশি চাপ। বিএনপি ভোট বর্জন করে প্রতিহতেরও ঘোষণা দেয়।

 

একপর্যায়ে তৎকালীন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন নিয়ে সংকট আরো ঘনীভূত হতে শুরু করে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা জোরালো চেষ্টা করেছিলেন দুই দলকে নিয়ে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের। কিন্তুতিনি খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। বরং তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনার শিকার হন।

 

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

 

তিনি জাপা চেয়ারম্যানকে আওয়ামী লীগের অধীনে ভোটে যাওয়ার জন্য অনেকটাই চাপ প্রয়োগ করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ওই নির্বাচনের আগে এরশাদ নানান বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে অসুস্থতা দেখিয়ে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয় বলে পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন তিনি।

 

সংকট তুঙ্গে ওঠার পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের এক টেবিলে নিয়ে বৈঠক করেন। সে সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সে বৈঠকের পর তারানকো জানিয়েছিলেন, দুই দলই ছাড় দিতে রাজি হয়েছে।

 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কোনো ফলাফল দেখা যায়নি। অনেকটা একতরফা ভোটের দিকে এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিলেও প্রশাসনের কড়াকড়িতে সেটি ব্যর্থ হয়।

 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত বেশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির দুই মামলায় সাজা হয়। দলটি আরো বিপাকে পড়ে।

 

এরপর প্রবীণ আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করে বিএনপি। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ করেন কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি নেতারা। ওই সংলাপে প্রধামন্ত্রী ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ও বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

 

কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল তার উল্টো। নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার আর আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ করে বিএনপি। ওই নির্বাচনেও অনেকটাই ফাঁকা মাঠে গোল দেয় আওয়ামী লীগ।

 

২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপি একলা চলো নীতিতে এগোতে থাকে। আস্তে আস্তে দলটি কোভিড-পরবর্তী সময়ে মাঠের কর্মসূচিতে নামে। দলটি ২০২২ সালে বছর শুরুর পর থেকেই ব্যাপকভাবে দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে মাঠে নামে। বিএনপি এখন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া ও তাদের অধীনে ভোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলটি আর ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

 

এর মধ্যে গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। ঘোষিত ওই ভিসানীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে বলে বলা হয়েছে। এই নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

 

অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর আগেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের ৮ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি।

 

পশ্চিমা দেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বে অনেকেই এখন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জোরালোভাবে বলতে শুরু করেছে। এরপরও আওয়ামী লীগ বরাবরই বলছে, তারা সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত¡াবধায়কে ফিরবে না। অন্যদিকে বিএনপি আগের অবস্থানে অনড়।

 

এমন অবস্থায় মঙ্গলবার ১৪ দলের বৈঠকে জোটটির মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু বলেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করবেন তারা। তিনি বলেন, আলোচনা করে সমাধান করতে কোনো সমস্যা নেই। আমুর বক্তব্যের পরদিনই গতকাল তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমির হোসেন আমুর বক্তব্য তার নিজের। এটি দলের কোনো বক্তব্য নয়।

 

এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

 

তবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সংলাপের দরকার আছে। আমাদের এক নেতা বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কথা বলেছেন। অবশ্যই সংলাপ ও আলোচনার বিকল্প কিছু নেই। আওয়ামী লীগ সংলাপে বিশ্বাসী। তবে, এখানে এমন কোনো কিছু হয়নি যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা লাগবে।

 

সংলাপ নিয়ে আওয়ামী নেতারা যখন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন, তখন বিষয়টি নিয়ে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি কী ভাবছে এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মাঝে।

 

এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের মন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে সংলাপের যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আপাতত আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। তবে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেলে জবাব দেয়ার জন্য ভাববে দলটি।

 

তিনি বলেন, কোথায় কোন সমাবেশে কে কী বলছে সেটার জবাব দেয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা রাজনীতি পরিবর্তন করছি। বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগের আগে কোনো সংলাপের কথা ভাবছে না বলেও জানান তিনি।

 

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তার ভাষ্য, ‘এতেই বোঝা যায় আওয়ামী লীগের কী অবস্থা।’

 

অবশ্য পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২০১৮ সালে আমাদের সঙ্গে সংলাপে দুবার বসে যে কমিটমেন্টগুলো আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, তার কোনোটাই রক্ষা করেনি। সেখানে আমির হোসেন আমুও ছিলেন। তাই আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই।

 

সেজন্য আমরা পরিষ্কার বলছি যে, অন্য কোনো বিষয়ের ওপর আলোচনার কোনো সুযোগই নেই। একমাত্র সরকারের পদত্যাগের পর নিরপেক্ষ সরকার কীভাবে হতে পারে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। তার আগে কোনো আলোচনা বা সংলাপ নয়।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, পদত্যাগের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। এটি বর্তমান সরকারের ফাঁদ বলেও মনে করেন তিনি।

 

এদিকে, বিএনপির মধ্যম ও মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে নানামুখী চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। সেই চাপের বিষয়টি ভিন্নদিকে প্রভাবিত করতেই বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি সামনে আনছে।

 

সরকার এখন বিদেশিদের দেখাতে চাইছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

 

এছাড়া বিএনপির আন্দোলনে নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতেও চক্রান্তের অংশ হিসেবে এসব করছে সরকার। কার্যত বিএনপিকে নির্বাচনে এনে ২০১৮ সালের মতোই ফাঁদে ফেলতে চাইছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version