-->

আন্দোলন বাস্তবায়ন কর্মসূচি জুলাইয়ে

এম সাইফুল ইসলাম
আন্দোলন বাস্তবায়ন কর্মসূচি জুলাইয়ে

এম সাইফুল ইসলাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিজেদের দাবি আদায়ে বিএনপি এখন জোরেশোরে রাজপথে। দলটি বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ক্রমেই এক দফার দিকে এগোচ্ছে। আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে এক দফা আন্দোলনে থাকার সিদ্ধান্তে অটুট দলের শীর্ষ নেতারা। তবে দাবি আদায়ে অবরোধ, ঘেরাও এবং অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির পথে হাঁটছে দলটি।

 

আর জুলাইয়ের শেষ ভাগে এ কঠোর কর্মসূচিতে যেতে চায় বিএনপি। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসায় এক দফার দিনক্ষণও এগিয়ে আসছে। মার্কিন ভিসানীতিতে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হলেও শুধুই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না দলটি।

 

এছাড়া সরকারের পদত্যাগের আগে তারা কোনো সংলাপ বা আলোচনার টোপেও পড়তে চান না।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন, দাবি আদায়ে আন্দোলনই তাদের একমাত্র ভরসা। এ কারণে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় ৭ মাস বাকি। তারপরও রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়।

 

আর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে এখন রাজপথে। দাবি আদায়ে বিএনপি এখন বেশ জোরেশোরে মাঠে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি এ অবস্থানের মধ্যে গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির ঘোষণার পর দেশে রাজনীতিক পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটে বাধাদানকারীরা মার্কিন ভিসা পাবে না দেশটির এমন ঘোষণার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হয়েছে।

 

সরকার যাই বলুক না কেন, এ ভিসানীতি যে সরকারের বিপক্ষে এসেছে, সেটি তাদের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পশ্চিমারা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা এবার সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব তৎপরতায় বিএনপির আন্দোলনে গতি বাড়ছে। মনোবল দৃঢ় হচ্ছে রাজপথের এ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। গত দুই বছর সতর্কভাবে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে পথচলা বিএনপি নিজেদের দাবি আদায়েও এবার বেশ সিরিয়াস।

 

গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের পর বিএনপি ১০ দফা দাবিতে কয়েকধাপে বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দলের বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা মতবিনিময় করেছেন। এছাড়া দলটির বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি; বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও বৈঠকে করে দলটি।

 

বিএনপি এবার রমজানজুড়েও মাঠের কর্মসূচিতে ছিল। বিএনপির সঙ্গে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎভাবে কজর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির ১০ দফা দাবির প্রতি সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে। যদিও বিএনপি ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে দেয়া ১০ দফার প্রতি জামায়াত সমর্থন জানিয়ে কিছুটা গতিহীন থাকলেও দলটি আবারো সক্রিয় হচ্ছে।

 

শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়াও ঠিক করেছে বিএনপি। গত এপ্রিল মাসজুড়ে দলটির নেতারা যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত কর্মসূচি, আন্দোলনের ধরন নিয়ে বৈঠক করেছে। যৌথ ঘোষণাপত্র, কর্মসূচি ও আন্দোলনের নানা কৌশল নিয়ে এসব বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নিজেদের মধ্যে মান অভিমান নিয়েও পরস্পরের আলোচনায় উঠে আসে।

 

বিএনপি এখন সরকারের পদত্যাগ দাবির পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে। শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ সব খাতে লুটপাটের প্রতিবাদে ও সরকারের পদত্যাগ দাবিতে শুক্রবার রাজধানীতে বৃষ্টির মধ্যেও নয়াপল্টনে সমাবেশ করে।

 

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দেশের জেলা পর্যায়ে লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। একই দাবিতে আগামী ১৩ জুন সারা দেশে মহানগর পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি রয়েছে দলটির। ১৬ জুন ঢাকা মহানগরীর দুই শাখা লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে রাজধানীতে পদযাত্রা করবে। দলটির দ্রæত সময়ে নারী সমাবেশ করবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। এ সমাবেশ বাস্তবায়নে স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানকে আহব্বায়ক করে একটি কমিটিও করে দেয়া হয়েছে।

 

জানা গেছে, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সমন্বয়ে ৫ বিভাগ ও জেলা শহরে বগুড়ায় ‘তারুণ্য সমাবেশ’র কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ২ জুন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ‘তারুণ্য সমাবেশের’ ঘোষণা দিলেও যুবলীগ একই স্থানে সমাবেশের ঘোষণা দেয়ায় গত ৭ জুন তারিখ পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী ১৪ জুন চট্টগ্রামে, ১৯ জুন বগুড়ায়, ২৪ জুন বরিশালে, ৯ জুলাই সিলেটে, ১৭ জুলাই খুলনায় ও ২২ জুলাই ঢাকায় তারুণ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, আসন্ন ঈদের পরে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিএনপি কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। তারুণ্য সমাবেশে ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনা বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের। এ সমাবেশে কমবেশি বাধা আসতে পারে বলে তাদের ধারণা। ২২ জুলাই ঢাকার সমাবেশে সরকার বাধা দিলে তখনই বিএনপি এক দফার কঠোর কর্মসূচিতে যাবে।

 

বিএনপির কঠোর আন্দোলনে কী কর্মসূচি দেয়া হতে পারে, তা অনুসন্ধানে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয় ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে। নেতাকর্মীরা বলছেন, দল এখন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে থাকতে চায়। সেক্ষেত্রে তারা ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’কে বেছে নিতে চান। চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেল ও নৌপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে।

 

এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসক ও এসপির কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে।

 

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করতে চায়।

 

হরতালের মতো কর্মসূচি বিএনপি কেন এড়িয়ে চলছে এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, এ ধরনের কর্মসূচিতে সরকার নানা কায়দায় সহিংসতার পথ তৈরি করতে পারে। যার দায়ভার বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার শঙ্কা রয়েছে বিএনপির। ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনের সময় বিএনপি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বলে মনে করছে। কর্মসূচিতে শরিকদের সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি।

 

কর্মসূচি পালনে একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে জড়ো না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়ার ব্যাপারেও শরিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এখন থেকে শরিকদের মাঠে শক্তভাবে নামতেও নির্দেশনা রয়েছে বিএনপির।

 

এছাড়া বিএনপি এখন জোর কূটনৈতিক তৎপরতায় চালাচ্ছে। বিএনপির প্রতিনিধি দল এখন প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক এখন বিএনপির যেন রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। আগামীতে এ তৎপরতা আরো বাড়াবে বিএনপি।

 

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বীরপ্রতীক ভোরের আকাশকে বলেন, আগামীতে দাবি আদায়ে এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএনপি শিগগিরই যে আন্দোলনের ডাক দেবে, সেখানে শরিকদের সর্বাত্মক মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপার (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠকে কর্মসূচির ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি আমাদের সিরিয়াসলি মাঠে থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আন্দোলনেই ভরসা বলেও মনে করেন তিনি।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বাইরেও সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। তারা জানে গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।

 

শিগগিরই আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তাই দ্রুত সময়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাবে। তার জন্যে বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রস্তুত। এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছে না। পদত্যাগের আগে সরকার টোপ হিসেবে সংলাপে ডাকতে পারে। তাতে বিএনপির যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দাবি মানতে বাধ্য করাতে রাজপথের কোনো বিকল্প নেই।

 

এক প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফেরাতে গণতন্ত্রমনাদের সহযোগিতা খারাপ কিছু নয়। গণতন্ত্রকামী দেশগুলো চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র বজায় থাকুক।

 

আর স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, আগামীতে সরকারের পদত্যাগে তারা রাজপথে কঠোর আন্দোলন করবেন। রাজপথের বিকল্প তিনি কিছু দেখছেন না।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version