-->
শিরোনাম

বিএনপির নেতৃত্বে সমমনাদের যুগপৎ আন্দোলনে ‘এক দফা’র প্রস্তুতি

এম সাইফুল ইসলাম
বিএনপির নেতৃত্বে সমমনাদের যুগপৎ আন্দোলনে ‘এক দফা’র প্রস্তুতি

এম সাইফুল ইসলাম: বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো সবাই এখন ‘এক দফা’র প্রস্তুতি নিচ্ছে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বিএনপির নির্দেশনায় মাঠ পর্যায় বা তৃণমূলে বার্তা পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন দলগুলোর নেতারা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একসঙ্গে রাজপথে নামার আগে দলগুলো এখন সতর্কভাবে ব্যস্ত মাঠ প্রস্তুত করতে।

 

বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের নেতারা এসব তথ্য স্বীকার করে বলছেন, সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি নানা চাপ থাকলেও আগামীতে এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথই একমাত্র ভরসা।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় ছয় মাস বাকি। তারপরও রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে এখন রাজপথে।

 

দাবি আদায়ে বিএনপি এখন বেশ জোরেশোরে মাঠে। বিশেষ করে গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির ঘোষণার পর বিএনপি আরো নড়েচড়ে বসে। দলটির নেতাকর্মীরা এখন বেশ উজ্জীবিত। অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটে বাধাদানকারীরা মার্কিন ভিসা পাবে নাÑ দেশটির এমন ঘোষণার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হয়েছে।

 

মার্কিন ছাড়াও পশ্চিমাে দেশসমূহ এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা এবার সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব তৎপরতায় বিএনপির আন্দোলনে গতি বাড়ছে। মনোবল দৃঢ় হচ্ছে রাজপথের এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। প্রায় দুই বছর থেকে বেশ সতর্কভাবে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে পথচলা বিএনপি নিজেদের দাবি আদায়েও এবার বেশ সিরিয়াস।

 

কার্যত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোট অনেকটাই অকার্যকর করে বিএনপি। তবে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর গুলশানে এক বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জোটটি ভেঙে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দলনিরপেক্ষ সরকারসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশে ওই ১০ দফা পেশ করা হয়।

 

একই সঙ্গে যুগপৎভাবে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই ঘোষণার পর বিএনপির সঙ্গে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির ১০ দফা দাবির প্রতি সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে।

 

বিএনপি সমমনাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গত কয়েক মাসে ৫/৬ দফা বৈঠক করেছে। চলতি মাসেও যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত কর্মসূচি, আন্দোলন ও আন্দোলনে জয়ী হলে ভোট-পরবর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্র মেরামতে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ তৈরি করতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। যৌথ ঘোষণাপত্র এখন চ‚ড়ান্তের পথে। এসব বৈঠকে নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান নিয়েও পরস্পরের আলোচনায় উঠে আসে।

 

বিএনপি এখন সরকারের পদত্যাগ দাবির পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে। গত দুই সপ্তাহে কয়েক দফা অব্যাহত লোডশেডিং ও বিদ্যুত খাতে দুর্নীতির প্রতিবাদ ও ১০ দফার দাবিতে ঢাকাসহ সব মহানগর ও জেলায় জেলায় পদযাত্রা ও সমাবেশ করেছে বিএনপি। এসব কর্মসূচির সমর্থনে এক দিন আগে বা পরে গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোট কর্মসূচি পালন করেছে।

 

গণতন্ত্র মঞ্চ দিনাজপুর অভিমুখে লংমার্চ করেছে। এছাড়া সংগঠনটি গতকালও সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা করার চেষ্টা করলেও তাতে বাধা দেয় পুলিশ। গণঅধিকার পরিষদও প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি পালন করছে। কর্নেল (অব.) অলির আহমাদের এলডিপিও কর্মসূচি পালন করছে। মাঠে রয়েছে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।

 

জানা গেছে, বিএনপির আন্দোলনে মাঠের শক্তিতে জামায়াত একটি বড় ফ্যাক্টর। ১০ দফার প্রতি জামায়াত সমর্থন জানিয়ে কিছুদিন গতিহীন থাকলেও দলটি আবারো সক্রিয়। গত সপ্তাহে পুলিশের অনুমতি নিয়ে জামায়াত রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয়। দলটি আগামীতে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াতকে নিয়ে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের নানা কথা শোনা গেলেও আগামীতে দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে মাঠে নামারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

 

গত এক মাসে জামায়াতের ঘরোয়া বৈঠকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন, কারারুদ্ধ নেতাদের মুক্তি, দলীয় কার্যালয় খুলে দেয়ার দাবিতে আগামীতে সর্বোচ্চভাবে কর্মীদের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বর্তমানে পর্দার আড়ালে নিয়মিত কথা হচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি শক্তভাবে মাঠে নামলে জামায়াতও মাঠে থাকবে বলে দল দুটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

 

এদিকে, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সমন্বয়ে ৫ বিভাগ ও জেলা শহরে বগুড়ায় ‘তারুণ্য সমাবেশ’ ঘোষণা করে মাঠে বিএনপি। ১৪ জুন চট্টগ্রাম ও সোমবার বগুড়ায় এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া আগামী ২৪ জুন (শনিবার) বরিশালে, ৯ জুলাই (রোববার) সিলেটে, ১৭ জুলাই (সোমবার) খুলনায় ও ২২ জুলাই (শনিবার) ঢাকায় তারুণ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, আসন্ন ঈদের পরে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলসমূহ কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। আগামী ২২ জুলাই ঢাকার তারুণ্য সমাবেশে সরকার কঠোর অবস্থানে থেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তবে ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি এক দফার কঠোর কর্মসূচিতে যাবে। এছাড়া চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে ঢাকায় নারী সমাবেশ করতে চায়। ইতোপূর্বে দলের বর্তমান ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছে।

 

বিএনপি আগামীতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে থাকতে চায়। সেক্ষেত্রে তারা ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’কে বেছে নিতে চান। চ‚ড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ,পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে। এছাড়া সরকারি অফিস যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে।

 

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করতে চায়। সহিংসতার আশঙ্কায় হরতালের মতো কর্মসূচিতে বিএনপি যেতে চায় না।

 

কর্মসূচিতে শরিক বা সমমনারা সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী সমমনা দলের নেতারা তাদের দলকে প্রস্তুত করছেন। তারা তৃণমূলেও এসব বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক দলকে প্রস্তুত করছেন নেতারা।

 

আন্দোলন ও দলের অবস্থান প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন, নির্যাতন আমাদের নেতাকর্মীরা ভুলে যায়নি।

 

তাদের সঙ্গে আপস হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে যা কিছু করা দরকার, গণতান্ত্রিক অন্যান্য দলের মতো জামায়াতও তাই করবে। সেক্ষেত্রে সময়মতো মাঠে নামার প্রস্তুতিও তাদের রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডা. তাহের।

 

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ভোরের আকাশকে বলেন, আগামীতে দাবি আদায়ে এক দফার আন্দোলনের কে কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএনপি শিগগিরিই যে আন্দোলনের ডাক দেবে সেখানে শরিকদের সর্বাত্মক মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপা (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠকে কর্মসূচির ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি আমাদেরকে সিরিয়াসলি মাঠে থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আন্দোলনেই ভরসা বলে মনে করেন তিনি।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের বাইরেও সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। তারা জানে গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।

 

তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তাই দ্রুত সময়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাবে। তার জন্য বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রস্তুত। এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছে না। পদত্যাগের আগে সরকার টোপ হিসেবে সংলাপে ডাকতে পারে। তাতে বিএনপির যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দাবি মানতে বাধ্য করাতে রাজপথের কোনো বিকল্প নেই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version