এম সাইফুল ইসলাম: আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলতি মাসব্যাপী বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এই সফরকালে তাদের কাছে ভোটাধিকার হরণের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি।
পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনকারী বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি বিদেশিদের কাছে তুলে ধরা হবে। দলটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় সেটি প্রমাণে যৌক্তিক কারণ কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরবে দলটি।
নেতাদের পাশাপশি বিএনপিমনা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও এ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পরামর্শ রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদেশিদের এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে বলছেন, বাংলাদেশে ভোটাধিকার হরণের বিষয়টি বিদেশিরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছে। আর এ কারণে তারা ভিসানীতিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সফরকালে তাদের কাছে ভোটাধিকার হরণ ও বিরোধীদের নির্যাতনের তথ্য বিএনপির তুলে ধরাটাই স্বাভাবিক।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় ৬ মাস বাকি। এরই মধ্যে দেশের রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অনড়। ঠিক সেই মুহূর্তে ভূরাজনীতি আর চাওয়া-পাওয়ার নানা হিসাবে রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বাইরের রাষ্ট্র বা সংস্থাগুলোর।
জানা গেছে, ৮ জুলাই ঢাকা পৌঁছাবে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। তারা মূলত নির্বাচনের সময়ে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। ইইউর প্রতিনিধি দলের এ সফরটি হবে ১০ দিনের। এ সময় তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকার ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি জানিয়েছেন, প্রাক-নির্বাচনী পর্যেবক্ষক দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখবে। সেই সঙ্গে ইইউর পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসতে পারবেন কিনা, সেটি খতিয়ে দেখবেন। এই প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ দল আসার আগে ইইউ রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকের এক দিন পর বুধবার ইইউভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের চা চক্রে ডেকেছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, এই চা চক্রের আলোচনায় মূলত বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন স্থান পায়।
আগামী ১১ জুলাই ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া। তার বৈঠকে গুরুত্ব পাবে শ্রম পরিস্থিতি, নাগরিক সমাজের স্থান সংকোচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উজরা জিয়ার নেতৃত্বে সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুও থাকবেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শ্রমিক প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে তাদের। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জুলাই মাসের বিভিন্ন সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উজরা জিয়া বাংলাদেশ আসছেন এবং তাকে আমরা স্বাগত জানাই।
এছাড়া আগের দেয়া শর্ত পূরণ হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র উচ্চপর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপে যোগ দিতে আসবেন এ মাসেই হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ। তাও হচ্ছে এই জুলাই মাসেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি। অবশ্য তার ঢাকা সফর এখনো শর্তের বেড়াজালে আটকে রয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ত্রুটি পূর্ণ দাবি করে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশসমূহের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতেও সরব ছিল তারা। উন্নয়ন সহযোগী এসব দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশে ভোটাধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় নানা সময়ে সরকারের প্রতি জোর তাগিদ দিয়ে আসছে।
এরই অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের ৭ বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। দেশটির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে অনেকটাই চাপ প্রয়োগ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের বিষয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশটির। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন এই সিদ্ধান্ত কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছে।
চলমান এই প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে বিদেশি ক‚টনীতিকদের বাংলাদেশে অবস্থানকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিদেশিদের সফরকালে বৈঠকে গত দুটি সংসদ নির্বাচনের চিত্র তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপন করবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। এছাড়া বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রশাসনকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করার চিত্র তুলে ধরবে দলটি।
পাশাপাশি র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা বিরোধী দল ও মতের মানুষকে গুম, হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের তথ্যচিত্র তুলে ধরবে বিএনপি। সাংবাদিকদের দমনে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রয়োগের বিষয়টি সামনে আনবেন বিএনপি নেতারা। দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা সরবরাহের উপযোগী করতে কাজ করছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে না, তার সপক্ষে সব ধরনের যৌক্তিক কারণ তুলে ধরবে বিএনপি। নিজেদের পক্ষে কাজ করতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন দলটির হাইকমান্ড। তবে বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইছেন না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি চায় দেশে গণতন্ত্র ও ভোটধিকার ফিরে আসুক। এ বিষয়ে বিশ্বের যে কারো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে জুলাই মাসব্যাপী কূটনীতিকদের সফরে বিএনপির কর্মপরিধির ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দেশে মানুষের ভোট দেয়ার অধিকার নেই সেটা এখন বিশ্বের সবাই জানে। যে কারণে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটে বাধাদানকারীদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। দেশে ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে গণতন্ত্রমনা বিদেশিদের সহযোগিতা দোষের কিছু নয়। কূটনীতিকদের এবারের সফরে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে তথ্য-উপাত্ত দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, বিদেশিদের এখনকার সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে বাইরের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। তারপরও কূটনীতিকদের সফরে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যে যার পক্ষে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবেন, এটাই এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য