এম সাইফুল ইসলাম: সরকারবিরোধী ‘এক দফা’র আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও সময়সীমা নির্ধারণের সমীকরণে ব্যস্ত রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। এরই মধ্যে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা অপরাপর দলের নেতাদের মতামত নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তাদের কাছ থেকে আন্দোলন শুরুর দিনক্ষণ ও সময়সীমা সম্পর্কে নেয়া পরামর্শ ও নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মধ্য জুলাই থেকেই এক দফার কর্মসূচি দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এরই অংশ হিসেবে চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হবে। আর শেষ পর্যায়ে গতানুগতিকের বাইরে ভিন্ন ধরনের ‘শর্টটার্ম’ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর বর্হিবিশ্বের অব্যাহত কূটনৈতিক চাপকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপিসহ সমমনারা।
বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের নেতারা বলছেন, সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি নানা চাপ থাকলেও আগামীতে এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথই একমাত্র ভরসা। সেই জায়গা থেকে বিএনপির নেতৃত্বে তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় ছয় মাস বাকি। রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে এখন বেশ জোরেশোরে মাঠে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর অকার্যকর হয়ে পড়া ২০ দলীয় জোট গত বছরের ৯ ডিসেম্বর গুলশানে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ভেঙে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দলনিরপেক্ষ সরকারসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে ১০ দফা ঘোষণার পর দলটির সঙ্গে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে।
পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির ১০ দফা দাবির প্রতি সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে। একইসঙ্গে আন্দোলন ও আন্দোলনে জয়ী হলে ভোট-পরবর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্র মেরামতে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ তৈরির কাজ করে আসছে বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনকারী এসব দল এখন মাঠের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। গত কয়েক মাসে এসব দল ও জোট সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠের শক্তিতে জামায়াত একটি বড় ফ্যাক্টর। ১০ দফার প্রতি জামায়াত সমর্থন জানিয়ে কিছুদিন গতিহীন থাকলেও দলটি আবারো সক্রিয়। পুলিশের অনুমতি নিয়ে গত ১০ জুন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনে সমাবেশ করে নিজেদের সক্ষমতার জানান দেয় জামায়াত। তারা রাজধানীর মিরপুরে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
এছাড়া দলটি আগামীতে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জামায়াতকে নিয়ে সরকারের সঙ্গে আঁতাতের নানা কথা শোনা গেলেও আগামীতে দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে মাঠে থাকারও ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
চলমান এ অবস্থায় অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বর্হিবিশ্বের চাপও বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে সুষ্ঠু ভোটে বাধাদানকারীরা ভিসা পাবে না জানিয়ে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির ঘোষণায় বিএনপি নেতাকর্মীরা আরো উজ্জীবিত হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সর্বোপরি পশ্চিমা দেশ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের তৎপরতায় চাঙ্গা বিএনপিসহ আন্দোলনে থাকা দলের নেতাকর্মীরা। বিদেশিদের অব্যাহত তৎপরতার অংশ হিসেবে আজ শনিবার ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের।
দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে। তারা মূলত নির্বাচনের সময়ে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। তাদের ১০ দিনের সফরে এ সময় তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন।
এছাড়াও আগামী ১১ জুলাই ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। উজরা জেয়ার নেতৃত্বে সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুও থাকবেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আগের দেয়া শর্ত পূরণ হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপে যোগ দিতে এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি হোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।
এসব তৎপরতায় বিএনপির আন্দোলনে গতি বাড়ছে। মনোবল দৃঢ় হচ্ছে রাজপথের এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। প্রায় দুই বছর থেকে বেশ সতর্কভাবে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে পথচলা বিএনপি এবার নির্বাচনের প্রায় ৬ মাস বাকি থাকলেও কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বড় আন্দোলন করে সরকারকে আরো চাপে ফেলতে চায়। দলটি চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এক দফার আন্দোলন শুরু করতে চায়। শুরুর দিকে আবারো পদযাত্রা, বিক্ষোভ কর্মসূচির মতো স্বাভাবিক কর্মসূচি দিয়ে শুরু করতে চায়। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে দলটির কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসবে।
জানা গেছে, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সমন্বয়ে ‘তারুণ্য সমাবেশে’র শেষ হবে ২২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশের মাধ্যমে। ওই সমাবেশ থেকে কিংবা এর আগেই ঢাকায় একটি বড় জনসমাগম ঘটিয়ে এক দফার কর্মসূচি ঘোষণা করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি।
ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে গত সপ্তাহে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। শুক্রবারও বৈঠক হয়েছে দুটি দলের সঙ্গে। এসব বৈঠকে কবে থেকে এক দফা শুরু করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এছাড়া চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন এবার ‘শর্টটার্ম’ করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। অতীতের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করেই এবার অল্প দিনে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত বিএনপি ও তার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের।
জানা গেছে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি শুরু করলেও একটা পর্যায়ে ১৫/২০ দিনের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে চায় বিএনপি। অল্পদিনের কঠোর কর্মসূচির মধ্যে ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’কে বেছে নিতে চায় তারা। চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে।
এছাড়া সরকারি অফিস যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করতে চায়। সহিংসতার আশঙ্কায় হরতালের মতো কর্মসূচিতে বিএনপি যেতে চায় না।
কর্মসূচিতে শরিক বা সমমনারা সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী সমমনা দলের নেতারা তাদের দলকে প্রস্তুত করছেন। তারা তৃণমূলেও এসব বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক দলকে প্রস্তুত করছেন নেতারা।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম ভোরের আকাশকে আন্দোলনের বিষয়ে বলেন, দাবি আদায়ে এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএনপি শিগগিরই যে ভিন্নধারার আন্দোলনের ডাক দেবে সেখানে শরিকদের সর্বাত্মক মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা প্রস্তুত আন্দোলন করতে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপার (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠকে কর্মসূচির ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি আমাদেরকে সিরিয়াসলি মাঠে থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আন্দোলনেই ভরসা বলেও মনে করেন তিনি।
আন্দোলন ও দলের অবস্থান প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন, নির্যাতন আমাদের নেতাকর্মীরা ভুলে যায়নি। তাদের সঙ্গে আপস হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে যা কিছু করার দরকার, গণতান্ত্রিক অন্যান্য দলের মতো জামায়াতও তাই করবে। সেক্ষেত্রে সময়মতো মাঠে নামার প্রস্তুতিও তাদের রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডা. তাহের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বর্হিবিশ্বের সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। তারা জানে, গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তাই দ্রুত সময়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাবে। দাবি মানতে বাধ্য করাতে রাজপথের কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য বিএনপি ও তার মিত্রদের প্রস্তুত ও পরামর্শ গ্রহণে আমরা গত সপ্তাহ থেকে বৈঠক শুরু করেছি। এসব বৈঠকে আন্দোলনের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য