এম সাইফুল ইসলাম: জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের যখন ভারতে অবস্থান করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এবার নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা নিয়ে দিনভর তুলকালাম কান্ড ঘটেছে। দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা এবং জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দেয়া সংক্রান্ত সংবাদ মঙ্গলবার দিনভর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ সংবাদ প্রকাশের পর দেবর-ভাবি দ্বন্দ্ব চরমে এবং জাপায় ফের ভাঙন আসছে এমন আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে দিন শেষে রওশন এরশাদের চেয়ারম্যান ঘোষণার সংবাদটি ভুয়া হিসেবে দুই পক্ষই দাবি করেছে।
জাপার সেক্রেটারি ও দুজন কো-চেয়ারম্যান বলেছেন, এটি ‘ফেক’ নিউজ। ভিত্তিহীন এ কাজটি যারা করেছেন, তারা দলকে ক্ষতি করতেই ‘ষড়যন্ত্র’ করেছেন। দিনভর দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সংগঠনবিরোধীদের ব্যাপারে দেয়া কড়া বক্তব্যের পর রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহও বলেন, এ বিজ্ঞপ্তিটি সম্পূর্ণ ভুয়া। এছাড়া এমন সংবাদ প্রকাশের পর রওশন এরশাদ জিএম কাদেরকে ফোন দিয়ে বলেছেন, এ বিজ্ঞপ্তি ভুয়া।
জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাপার অবস্থান কী হবে সে প্রশ্নে অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা। দলটির ক্ষমতাভোগী নেতারা সবসময় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
অন্যদিকে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। অনেক সভা সেমিনারে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে সেমিনারে তার বক্তব্য বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে মিলে যায়। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করেননি কোনো সময়। তিনি সবসময় বলেছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের আগে তিনি নেতাদের সমন্বয়ে সিদ্ধাান্ত নেবেন। দলের বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নেতা খেন বেশিরভাগ তার পক্ষে।
এদিকে দলে কোণঠাসা রওশন এরশাদ সবসময় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। মূলত সরকারের বিশেষ মহলেরও রওশন এরশাদের ব্যাপারে ইতিবাচক। অন্যদিকে জিএম কাদের শেষ পর্যন্ত কোনদিকে হাঁটবেন, তা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে নানা সন্দেহ আছে। চলমান এ অবস্থান গত ১৯ আগস্ট রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে চলমান রাজনীতি; বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে আলেচনা হয়। ওই বৈঠকের পর খবর প্রকাশিত হয়েছে, নিজের পছন্দের ছাড়াও মোট ৪০টি আসনের প্রার্থী তালিকা তিনি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
এদিকে গত ২০ আগস্ট জাপা চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা জিএম কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গেছে। তার সফরেও মূলত নির্বাচন নিয়ে ও সেদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এর কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে সফর শেষ করে দেশে ফিরেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের মাত্র তিন দিনের মাথায় গতকাল সকালে কাজী লুৎফুল কবীর নামে এক ব্যক্তি নিজে ‘প্রেস নোট (জাপা)’ নামের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দশম জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ’।
এছাড়া নানা কারণে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলেও ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে একটি রেজুলেশনও পাঠানো হয়। দলের প্যাডে উল্লেখ করা ওই রেজুলেশনে বলা হয়েছে, মামলা-মোকদ্দমায় পার্টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনে পার্টির ৪ জন কো-চেয়ারম্যান ও দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশদ এরশাদকে সংকটে বিশেষ ভূমিকা রাখতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।
২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর গৃহীত এ রেজুলেশনে কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও নাছরিন জাহান রত্নার সাক্ষর দেখানো হয়েছে।
গণমাধ্যমে পাঠানো রওশন এরশাদের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এ মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’ এ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন।
জানা গেছে, রওশন এরশাদের নামে ইস্যু করা এ প্রেস বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি জাপা সেক্রেটারি নিজেও জানেন না। আবার কো-চেয়ারম্যান হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা নিজেরাও বিষয়টি জানেন না। দুপুরে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এটা ফেক নিউজ। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, দলের কো-চেয়ারম্যান, তারা এ সিদ্ধান্তে কোনো সাইন করেননি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলে চেয়ারম্যান হতে পারে না। কাউকে অব্যাহতি দিতেও পারে না। জাতীয় পার্টি জিএম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা জাতীয় পার্টিতে ঘটেনি।’ নেতাকর্মীদের বিভ্রান্তি না হওয়ার আহব্বান জানান চুন্নু।
জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, এটা খুব ফালতু হয়েছে। এসব কিছু জানি না। জাতীয় পার্টি জিএম কাদেরের নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ দল। আরেক কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জিএম কাদেরকে তথাকথিত অব্যাহতির বিষয়ে আমি কোনো স্বাক্ষর করিনি।
যারা এগুলো করছেন তারা দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র করছেন। বিষষ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বিকেলে গণমাধ্যমকে জানান, রওশন এরশাদ এ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেন না। দলের অতিউৎসাহী কতিপয় ব্যক্তি এ কাজ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এভাবে কারো চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই চেয়ারম্যান হতে হয়।
এছাড়া জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন গণমাধ্যমে বলেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ তার নামে প্রচারিত সংবাদটি দেখার পরে তিনি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফোন করেন। এ সময় রওশন এরশাদ ওই সংবাদ ভিত্তিহীন বলে জিএম কাদেরকে নিশ্চিত করেন। এদিকে রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে প্রেস বিজ্ঞপ্তিকে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।
গতকাল দুপুরে বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনের সড়কে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক মাস আগেও শীর্ষ দুই নেতার বিরোধ তুঙ্গে ওঠার পর রওশনপন্থি এক নেতার মামলায় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে জিএম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আদালত। এদিকে চলমান এ অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীরা আবারো দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, এভাবে আসলে কোনো রাজনৈতিক দল সঠিকভাবে চলতে পারে না।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য