নিখিল মানখিন: রাজনৈতিক উত্তাপের মাস হবে সেপ্টেম্বর। এক দফা দাবির আন্দোলন সফল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে বিএনপি। আর পাল্টা কর্মসূচি নয়, নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির কর্মসূচিতে শান্তি সমাবেশের নামে পাল্টা কর্মসূচি রেখে রাজপথে অবস্থানের যে কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, সেই কৌশল পাল্টাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। দলটি এখন সরাসরি পাল্টা কর্মসূচি দেয়ার চেয়ে নিজেরা বড় জমায়েতের সমাবেশ করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এ নির্বাচন হবে। এর তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর হবে নির্বাচনী গতিপথ নির্ধারণের মাস। কিন্তু রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচনে যাবে না। আর বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচন করতে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এজন্য সেপ্টেম্বর মাস হবে রাজনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশ করে আসছে আওয়ামী লীগ। এবার সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিজেরা কর্মসূচি গ্রহণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী থাকবে দলটি। পুরোপুরি নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ। দলটির তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে-ময়দানে জনসংযোগ শুরু করেছেন।
মূলত নির্বাচনী আমেজ জোরালো করার লক্ষ্য থেকে আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কিছু বড় জমায়েত করবে দলটি। এসব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে তাদের এমন কৌশলের কথা জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, শোকাবহ মাস আগস্টের আবহ পুরোপুরিভাবেই আওয়ামী লীগের অনুক‚লে। দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শোকের মাসের কর্মসূচির দখলে রয়েছে সারা দেশ। এই মাসে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ (উড়াল সড়ক) বড় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছে সরকার।
এসব প্রকল্পের উদ্বোধনকে ঘিরে সুধী সমাবেশ বা সমাবেশে বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীন দল। এসব সমাবেশের সাজসজ্জা, ব্যানার ও নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে নির্বাচনী আমেজ আনার চেষ্টা থাকবে। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে রাজনৈতিক সমাবেশ বা জনসভা করা হবে বলে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে প্রথম সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন ঢাকার উড়াল সড়কের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ চালু করে আগারগাঁওয়ে সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এটি হবে সুধী সমাবেশ। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সুধী সমাবেশেই কয়েক লাখ লোকের জমায়েত নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, ঢাকা জেলা এবং আশপাশের জেলা থেকেও নেতাকর্মীদের আনা হবে।
গত শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের মিছিল মানেই সারা শহরে মিছিল আর মিছিল। আপনারা মিছিল দেখবেন এক তারিখ এবং দুই তারিখে (১ ও ২ সেপ্টেম্বর)। আমরা বিজয়ের পতাকা নিয়ে মিছিল করব, বিএনপির মতো শোকের কালো পতাকা নিয়ে নয়।
আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আগারগাঁওয়ে ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড়’ সমাবেশ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, পাল্টা কর্মসূচি নয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাজপথে আছে। প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশগুলোও নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিএনপি এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এক দফা দাবিতে তারা আগস্টজুড়েই কিছু কিছু কর্মসূচি পালন করে চলেছে। সেপ্টেম্বরে তারা সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে চায়।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরে তারা কিছু নিত্যনতুন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে টালমাটাল করে দেবে। কর্মসূচিগুলোর কথা বিএনপি নেতারা ভাবছেন এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে তারা আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করছেন।
বিএনপি নেতারা নিশ্চিত করেছেন, পুরো সেপ্টেম্বরজুড়ে তারা সরকারকে দম ফেলার সুযোগ দেবে না এবং এই রকম একটি পরিস্থিতি তৈরি করেই তারা সরকারের পতন করবে। বিএনপির বিভিন্ন নেতা বলছেন, সেপ্টেম্বরে যদি তারা একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বাধ্য করতে পারে, তাহলে তারা আন্দোলনে বিজয়ী হবে। অন্যথায় তাদেরকে নির্বাচনের পথেই যেতে হবে। অর্থাৎ এক মাসের একটি টর্নেডো দিয়ে বিএনপি সরকারকে হটাতে চায়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী রাজনীতিতেই অটল থাকতে চায়, যত বিদেশি চাপ বা হস্তক্ষেপ হোক না কেন- আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রেখে নির্বাচনের পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এখান থেকে পিছু হটার কোনো উপায় নেই। তবে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সমঝোতা এবং নির্বাচনের জন্য অক্টোবরে বেশ কিছু চমক দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনার জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাব দেবেন এবং বেশ কিছু নাটকীয় ঘোষণা দিবেন।
সেপ্টেম্বরে বিএনপি: দেড় বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থেকে গত ১২ জুলাই সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। এ দাবিতে পালিত হয় গণমিছিল ও মহাসমাবেশের মতো বড় কর্মসূচি। কিন্তু ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশের পরের দিন ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি বলে আলোচনা চলছে দলের মধ্যে। এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সূত্র বলছে, অবস্থান কর্মসূচির পর এক দফা আন্দোলনে বিএনপি কিছুটা বিরতি টানলেও ফের পূর্ণ শক্তি নিয়ে রাজপথ দখলে নেয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচির পথেই হাঁটার আপাতত সিদ্ধান্ত রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। আর এর জন্য সেপ্টেম্বর মাসকেই বেছে নেয়ার কথা ভাবছে দলটি।
যদিও সেপ্টেম্বরে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে, সে বিষয়ে শীর্ষ নেতারা খোলাসা করে কিছু বলছেন না। তবে দলটির একটি সূত্র জানায়, আগস্ট মাসে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও পদযাত্রার মতো কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ফের রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও এবং লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি। তবে, এসব কর্মসূচিতে অতীতের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার সমর্থকদের বাধার সম্মুখীন হলেও রাজপথে মোকাবিলা করার নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সারা দেশের নেতাকর্মীরা সার্বক্ষণিকভাবে সজাগ আছে জানিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমরা প্রস্তুত। সরকার যত অত্যাচারই করুক সফল হবোই।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য