-->

গুমোট হাওয়া রাজনীতিতে

এম সাইফুল ইসলাম
গুমোট হাওয়া রাজনীতিতে

এম সাইফুল ইসলাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর বিএনপি সরকারের পদত্যাগর দাবিতে এক দফা আন্দোলনে মাঠে।

 

এছাড়া বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এখন সোচ্চার। এ অবস্থায় হঠাৎ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিবসহ দল দুটির কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থানের খবরেও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারের বিষয়ে বিশ্বনেতাদের সর্বোচ্চ তৎপরতায় নানা প্রশ্ন সামনে এসেছে।

 

সার্বিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ জনগণসহ সর্বত্র একটাই প্রশ্ন কী হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে? দেশের রাজনীতিতে গুমোট এই আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বেও বিষয়টি উঠে আসে।

 

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সাংবিধানিক ধারা বজায় থাকায় দেশে স্বাভাবিক অবস্থা রয়েছে। এ ধারায় দেশে স্বাভাবিক অবস্থা থাকবে। তবে বিএনপি নেতারা বলেছেন, গুমোট এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে দেশের মানুষ তাদের হারানো অধিকার ফিরে পাবে। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও দেশে কী হচ্ছে আর কী হবে সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় চার মাস বাকি থাকলেও নির্বাচনী মাঠ এখন সরগরম। এই নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপরীতমুখী অবস্থানে। রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে এখন রাজপথে।

 

গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে মার্কিন নতুন ভিসানীতির ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হয়। মার্কিন, ইইউ ছাড়াও পশ্চিমা দেশসমূহ এবং উন্নয়ন সহযোগীরা এবার সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব তৎপরতায় বিএনপির আন্দোলনে গতি বাড়ছে। মনোবল দৃঢ় হচ্ছে রাজপথের এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। প্রায় দুই বছর থেকে বেশ সতর্কভাবে মাঠের কর্মসূচি নিয়ে পথচলা বিএনপি নিজেদের দাবি আদায়েও এবার বেশ সিরিয়াস।

 

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির এক দফা দাবির প্রতি সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে।

 

সবশেষ এই কাতারে যুক্ত হয়েছে ব্যরিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। চলতি মাসেও যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলোর হাইকমান্ডের সঙ্গে বিএনপি নেতারা ফের বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে এসব দলকে শক্তভাবে ১ সেপ্টেম্বর থেকেই মাঠে নামার প্রস্তুত নিতে বলা হয়েছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যেই চ‚ড়ান্ত আন্দোলন করে দাবি আদায় করে ঘরে ফিরতে চায় বিএনপি ও সমমনারা। এক্ষত্রে দলটি সব ধরনের কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতিও নিয়েছে।

 

এদিকে, ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে বিএনপির প্রতিটি আন্দোলন-কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশ করে আসছে আওয়ামী লীগ। এবার সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিজেরা কর্মসূচি গ্রহণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছে দলটি। পুরোপুরি নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ। দলটির তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ শুরু করেছেন। মূলত নির্বাচনী আমেজ জোরালো করার লক্ষ্যে আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কিছু বড় জমায়েত করবে দলটি। এসব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন বলেও দলের নেতারা জানিয়েছেন।

 

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, শোকাবহ মাস আগস্টের আবহ পুরোপুরিভাবেই আওয়ামী লীগের অনুক‚লে ছিল। দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শোকের মাসের কর্মসূচির দখলে রয়েছে সারা দেশ। এই মাসে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ (উড়াল সড়ক) বড় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এসব প্রকল্পের উদ্বোধনকে ঘিরে সুধী সমাবেশ বা সমাবেশে বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা করেছে ক্ষমতাসীন দল।

 

এসব সমাবেশের সাজসজ্জা, ব্যানার ও নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে নির্বাচনী আমেজ আনার চেষ্টা থাকবে। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে রাজনৈতিক সমাবেশ বা জনসভা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে প্রথম সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হবে। ওই দিন ঢাকার উড়াল সড়কের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ চালু করে আগারগাঁওয়ে সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী।

 

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই সুধী সমাবেশে কয়েক লাখ লোকের জমায়েত নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত পুরো সময়টিতে আওয়ামী লীগ সর্বোাচ্চভাবে মাঠ দখলে রাখতে চায়।

 

রাজনীতির চলমান এই অবস্থায় এক দফার আন্দোলন চলাকালীন গত ২৪ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সস্ত্রীক সিঙ্গাপুরে যান চিকিৎসার জন্য। তার দুদিন পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সস্ত্রীক গিয়েছেন দেশটিতে। কয়েক মাস থেকেই সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ কয়েকজন নেতা বিদেশে অবস্থান করছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

 

এদিকে, প্রায় একই সময়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও দলটির প্রেসিডিয়ায় সদস্য ফখরুল ইমাম সিঙ্গাপুর যান। সেখানে তাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক হয়েছে বলে একাধিক মিডিয়া সংবাদ প্রকাশ করেছে। জানা যায়, চুন্নু সস্ত্রীক থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি সিঙ্গাপুর যান।

 

তবে, বিশেষ কোনো বৈঠকের খবর নাকচ করেছেন বিএনপি ও জাপা নেতারা। দল দুটির নেতারা বলছেন, তারা চিকিৎসার জন্য কেউ থাইল্যান্ডে বা সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। তারপরও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলন চলাকালে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একের পর এক সিঙ্গাপুরে যাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে জাপা নেতাদের সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবরে সেই গুঞ্জনের ডালপালা আরো বেড়েছে।

 

এদিকে, চলমান এই অবস্থার মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার বিচারের বিষয়টি নতুনভাবে সামনে এসেছে। সরকার যখন ড. ইউনূসের বিচার করতে সচেষ্ট, তখন বিশ্ব নেতারা দাঁড়িয়েছেন এই নোবেল বিজয়ীর পাশে। একে একে বিশ্বের বিভিন্ন সেক্টরের ১৮৩ বিশিষ্ট ব্যক্তি ড. ইউনূসের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও হয়রানি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ড. ইউনূসকে হয়রানি বন্ধে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি ড. ইউনূসকে জাতির ‘সূর্য সন্তান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

 

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বুধবার সচিবালয়ে বলেছেন, বিএনপি ড. ইউনূসকে নিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের দুঃস্বপ্ন দেখছে। তিনি বলেন, আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে হটাতে পারেনি। তাই ড. ইউনূসকে নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে বিএনপি। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের এই অশুভ খেলা খেলতে দেয়া হবে না।

 

চলমান এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের জনসাধারণ থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে, দেশে আসলে কী হচ্ছে বা কী হবে আগামীতে? এই প্রশ্ন গণভবনে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেও উঠেছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, দেশের চলমান এই প্রেক্ষাপটে সর্বত্র জনসাধারণের প্রশ্ন দেশে কী হচ্ছে? সেই প্রশ্ন আমি আপনার কাছে দিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবলীলভাবে সেই প্রশ্নের দিয়েছিলেন।

 

দেশের রাজনীতিতে কোনো গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে কিনা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে সাংবিধানিক ধারা বজায় রয়েছে। তাই সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন হবে তাই কোনো ধরনের সমস্যা দেখছেন না এই আওয়ামী লীগ নেতা।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির বিদেশবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে বেশিদিন এ ধরনের গুমোট পরিবেশ থাকবে না। মানুষ তার হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনবে। দেশে ফিরে আসবে প্রকৃত গণতন্ত্র। যেখানে মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হবে।

 

দেশের সার্বিক এই প্রক্ষাপটে কী হচ্ছে বা হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের আকাশকে বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর আসলে সঠিকভাবে কারো জানা নেই। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, যদি নির্বাচনে জনসাধারণ অংশ নিতে পারে তাহলে সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

 

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্ব লক্ষণের নমুনা মিলছে না দাবি করে তিনি বলেন, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতেই সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। সেটি এখনো বিরাজমান। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এদেশে সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সুজন সম্পাদক। দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে একটি অবাধ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version