এম সাইফুল ইসলাম: অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে এবার ‘ওয়ার্মআপ’ অর্থাৎ মাঠ গরম করতে মাঠে নামছে বিএনপি। দলটি আগামীকাল শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশ করবে। আর রোববার থেকে দলটির তারুণ্যনির্ভর সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতৃত্বে রোডমার্চ শুরু হচ্ছে। প্রথমে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে এ লংমার্চ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি মাসের মধ্যে এটি পর্যায়ক্রমে সাংগঠনিক সব বিভাগে করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। পাশাপাশি চলবে মূল দল বিএনপির কর্মসূচিও।
সর্বশেষ ঢাকায় অনুষ্ঠিত রোডমার্চের পর অক্টোবরের শুরু থেকেই লাগাতার কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা বিএনপির। তার আগে দলটির মিত্রদের পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠনও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে কাজ করবেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি নানা চাপ থাকলেও এক দফা আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে চূড়ান্তভাবে রাজপথে নামার প্রস্তুতি চলছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় চার মাস বাকি। তারপরও রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়।
আর বিএনপি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ‘এক দফা আন্দোলনে’ এখন রাজপথে। দলটি চলতি বছরের শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। ঢাকায় মহাসমাবেশের পাশাপাশি বিভাগীয় সমাবেশ, সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রা ও গণমিছিলের মতো দলটির কর্মসূচিতে জনসমাগমও ছিল চোখে পড়ার মতো।
পাশাপাশি দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে তারুণ্য সমাবেশ, কৃষক সমাবেশ ও পেশাজীবী সমাবেশের কর্মসূচিতে বেশ চাঙা হয় নেতাকর্মীরা। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন। তবে গত ২৪ মে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে মার্কিন নতুন ভিসানীতির ঘোষণার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল আরো চাঙা হয়। মার্কিন, ইইউ ছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলো এবং উন্নয়ন সহযোগীরা এবার সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, গত জুলাইয়ে দলটির আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। গত ২৮ জুলাই বিএনপি ঢাকায় যে মহাসমাবেশ করেছিল, তা স্মরণকালের অন্যতম রাজনৈতিক জনসমাগম। ওইদিন মহাবেশ থেকে পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার চারটি প্রবেশ পথে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি। অনেকটাই সমন্বয়হীনতায় সেই কর্মসূচিতে দলটি শক্তভাবে মাঠে দাঁড়াতে পারেনি।
তবে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে প্রকাশ্যে পুলিশি পেটানোর ঘটনাসহ ব্যাপক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যাকশনের ঘটনা দেশ বিদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ পায় দলটি। ওই কর্মসূচির পর দলটির হাইকমান্ড আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। মাঠের কর্মসূচি কমিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি ও সমন্বয় বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হয় বিএনপি।
কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বেও পরিবর্তন এনেছে দলটি। আন্দোলনের ওই ছন্দপতনের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। আগে থেকেই সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এখন বিএনপির ওই তিন নেতাও ঢাকায়।
কিছুদিন বিরতি দেয়ার পর বিএনপি ফের সরকার পদত্যাগের দাবিতে এক দফার কর্মসূচি নিয়ে গত শনিবার থেকে মাঠে নামে বিএনপি। দলটি এবার ফাইনাল রাউন্ডের আন্দোলনে ‘শর্টটার্ম’ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। অক্টোবরের শুরুতেই আন্দোলন একটা বিশেষ পর্যায়ে নিতে চায়। তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে চায় বিএনপি। এখন থেকে দলটি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবে।
জানা গেছে, আগামী এক বা দুই সপ্তাহ ঢাকাসহ মহানগর ও জেলা পর্যায়ে স্বাভাবিক কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। পাশাপশি দলটি এবার তরুণদের মাঠে নামাতে বেশ তৎপর। যার অংশ হিসেবে দলটির তারুণ্যনির্ভর সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতৃত্বে তারুণ্যের রোডমার্চ শুরু হচ্ছে ১৬ সেপ্টেম্বর।
১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর উত্তরাঞ্চলের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরে লংমার্চ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি মাসের মধ্যে এটি পর্যায়ক্রমে সাংগঠনিক সব বিভাগে করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। সর্বশেষ ঢাকায় এ তিন বিভাগের লংমার্চ করার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগ মিলে ঢাকামুখী একটি রোডমার্চের পরিকল্পনা করছে বিএনপি।
ঢাকার ওই রোডমার্চ থেকেই বিশেষ কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা আছে বিএনপির। অথবা দলটি নয়াপল্টনে একটি মহাসমাবেশ করে বিশেষ কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারে। এর আগে দলটি ছাত্রদলের নেতৃত্বে বৃহত্তর ছাত্র ঐক্য গঠন ও পেশাজীবীদের মাঠে নামানোর কাজ করবে। পাশাপাশি বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনকারীদের মাঠে নামাতে আরো প্রস্তুত করতে নানামুখী তৎপরতা চালাবে।
জানা গেছে, আপাতত চলমান এসব কর্মসূচিতে বড় ধরনের বাধা এলে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কর্মসূচিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ অক্টোবর থেকে হার্ডলাইনের কর্মসূচিতে যাবে দলটি।
দলটির একজন যুগ্ম মহাসচিব ভোরের আকাশকে বলেন, দলটি প্রথমেই বিচারালয়ের সামনে অবস্থানের মাধ্যমে এক দফার হার্ড কর্মসূচির দিকে যাবে। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে থাকতে চায়। তবে বাধা এলে আর নরম কর্মসূচিতে থাকবে না দল। একপর্যায়ে ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’কে বেছে নেবে বিএনপি। চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে।
এছাড়া সরকারি অফিস; যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দাবি না মানলে লাগাতার অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচিও দেয়ার পরিকল্পনা আছে বিএনপিতে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করার সিদ্ধান্ত বিএনপির।
আন্দোলনে পুলিশি বা হয়রানির গ্রেপ্তারের বিষয়টি মাথায় রয়েছে বিএনপির। শীর্ষনেতারা বা সহযোগী সংগঠনের নেতারা গ্রেপ্তার হলে পরবর্তী সময়ে কারা দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়েও হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। শীর্ষনেতারা গ্রেপ্তার হলে আন্দোলন যেন থমকে না যায়, সেজন্য নেতৃত্বে তিন ধাপের নেতা বাচাই করা হয়েছে বলেও ছাত্রদলের এক নেতা জানিয়েছেন।
ছাত্রদলের সহসভাপতি নাছির উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, দল এখন এক দফা আন্দোলনে আছে। আগামীতে আন্দোলনের গতি আরো বাড়বে। দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফেরাতে দলের ঘোষিত কর্মসূচি পালনে ছাত্রদল তাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক যেকোনো আন্দোলনে ছাত্র, তরুণ ও যুবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেটি মাথায় রেখেই দল চূড়ান্ত আন্দোলনে আগে রোডমার্চ দিয়েছে তিন সংগঠনের।
যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন বলেন, দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে শুরু করে প্রতিটি মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে। প্রতিনিয়ত পুলিশ ও সরকারি দল মিলে আমাদের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করছে। এ পরিস্থিতিতে দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সেই দাবি আদায়ে বিএনপি কর্মসূচি যে দেবে, তাতে যুবদল সর্বোচ্চভাবে মাঠে থাকবে। শেষ মুহূর্তের রোডমার্চ বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা বলেও মনে করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশ ও দেশের বাইরেও সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন। তারা জানে, গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ এক দফার আন্দোলনে আছে। সময় বেশি নেই, সেটি মাথায় নিয়েই এগোচ্ছে দল। দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের জন্য বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রস্তুত। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ এবার বাস্তায় নেমে দাবি মানতে বাধ্য করবে বলেও মনে করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য