-->
শিরোনাম

সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলন ২০ সেপ্টেম্বরের পর লাগাতার মাঠে বিএনপি!

এম সাইফুল ইসলাম
সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলন
২০ সেপ্টেম্বরের পর লাগাতার মাঠে বিএনপি!

আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের পর লাগাতার মাঠে থাকার বার্তা দেয়া হয়েছে সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের। দলটির হাইকমান্ড আন্দোলন জোরদারের পাশাপাশি কর্মসূচি পালনে বাধা আসলে তা প্রতিরোধের নির্দেশনাও দিয়েছে। অবশ্য আগে থেকেই মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপি আন্দোলনের গতি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। অবশেষে গতকাল শুক্রবার দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘোষণায় তা স্পষ্ট হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এদিকে, আজ থেকে উত্তরবঙ্গে রোডমার্চ শুরু করেছে বিএনপির তিন অঙ্গসংগঠন।

 

বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারকে সরিয়ে দাবি মানতে বাধ্য করতে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই। তফশিল ঘোষণার আগেই সরকারকে চাপে ফেলতে এখনই আন্দোলনের মোক্ষম সময়। জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে ১০ দফা ঘোষণা করে। এরপর দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয় ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণ-অধিকার পরিষদ, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, ব্যরিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দল ও সংগঠন। পরে দলটি ১০ দফার পরিবর্তে গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর থেকে এক দফা দাবি আদায়ে রাজপথে ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে দলটি।

 

বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে দলটির সঙ্গে যুগপথের সমমনারাও রয়েছে। গত কয়েক মাস থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। মাঠের কর্মসূচি পালন করলেও আগে থেকেই আলোচনা ছিল বিএনপি মধ্য সেপ্টেম্বরের পর আন্দোলনে গতি বাড়াবে। এ নিয়ে দৈনিক ভোরের আকাশসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। অবশেষ গতকাল শুক্রবার দলটির নয়াপল্টন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা দিলেন, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিক নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ওই ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি লাগাতার মাঠের আন্দোলনে থাকবে।

 

মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রমাণিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্য বিএনপি এক দফা দিয়েছে। সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করা হয়েছে। কোথাও ন্যায়বিচার মিলছে না।

 

বিএনপির মহাসচিব আরো বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র ও সংগঠনটির পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টে রেজুলেশন আনা হয়েছে, সাজা প্রত্যাহারের কথা বলেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র নেই- সে কথাও তুলে ধরেছে ইইউ পার্লামেন্টে।

 

আদিলুর ও এলানের সাজা প্রত্যাহারের দাবি করে ফখরুল বলেন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট আরো ভয়াবহ। দমবন্ধ পরিবেশ চলছে। এ থেকে মুক্ত হতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান বিএনপির মহাসচিব।

 

জানা গেছে, গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। যার অংশ হিসেবে ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ২৯ জুলাই ঢাকার সব প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। গত ১১ ও ১৮ আগস্ট গণমিছিল হয়। এক দফা আন্দোলনের পঞ্চম কর্মসূচি ছিল গত ২৫ আগস্ট। ওইদিন বিএনপি এবং সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল, জোট ও বিএনপির সমমনারা ঢাকায় কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গণমিছিল করে বিএনপি। এটি ছিল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের বিএনপির ষষ্ঠ কর্মসূচি। সবশেষ গতকাল শুক্রবারও দলটি ঢাকায় একদফার যুগপথের ৭ম কর্মসূচি হিসেবে সমাবেশ করেছে। যদিও একদফার আগেও দলটি ১০ দফা নিয়ে আরো কয়েকটি যুগপৎ কর্মসূচি পালন করেছে।

 

এদিকে, বিএনপি মহাসচিব গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা বললেও আগেই তা তৃণমূলসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে বার্তা ছিল। এ বিষয়ে যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু ভোরের আকাশকে বলেন, মহাসচিবের ঘোষণায় আন্দোলনের স্পষ্ট বার্তা হয়েছে। তৃণমূল এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে মাঠে নামার জেরালো প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

 

যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন বলেছেন, ‘মহাসচিব স্যারের ঘোষণার আগেই আমাদেরকে কাছে বার্তা ছিল যেকোনো সময় আন্দোলনের ডাক আসবে। আন্দোলনে প্রস্তুত তৃণমূল। নেতাকর্মীরা এখন আন্দোলনের বিকল্প কিছু ভাবছে না।

 

ছাত্রদলের একজন সহ-সভাপতি ভোরের আকাশকে বলেছেন, মহাসচিব গতকাল ঘোষণা দিলেও আমরা আগে থেকেই জানি- ২০ তারিখের পর থেকে শক্তভাবে মাঠে থাকতে হবে। তার দাবি- দলের উচ্চপর্যায়ের এই বার্তা ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আগে থেকেই দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মসূচিতে পুলিশ অথবা সরকারি দল বাধা দিলে প্রতিরোধের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

 

ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নাছির উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফেরাতে দলের ঘোষিত কর্মসূচি পালনে ছাত্রদল অগ্রণী ভূমিকায় থাকবে। দেশের গণতান্ত্রিক যেকোনো আন্দোলনে ছাত্র, তরুণ ও যুবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেটি মাথায় রেখেই দল চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে রোডমার্চ দিয়েছে তিন সংগঠন। আগামীতে একদফা দাবি আদায়ে জোরালো কর্মসূচি আসছে সে বার্তা আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়েছে মহাসচিব স্যারের ঘোষণায়।

 

দলটির নেতারা বলছেন, অঙ্গ সংগঠনের নিজস্ব কর্মসূচি ছাড়াও মূল দল বিএনপির জোরালে কর্মসূচি থাকবে। এবার ফাইনাল রাউন্ডের আন্দোলনে ‘শর্ট টার্ম’ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দল। চলতি মাসের বাকি দিনগুলো ‘ওয়ার্ম আপে’ জোরালোভাবে মাঠে থাকছে বিএনপি। অক্টোবরের শুরুতেই আন্দোলন একটা বিশেষ পর্যায়ে নিতে চায়। তফশিল ঘোষণার আগেই সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে চায় বিএনপি। তাই এখন থেকে দলটি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবে।

 

দলটি এবার তরুণদের মাঠে নামাতে বেশ তৎপর। যার অংশ হিসেবে আজ থেকে দলটির তারুণ্যনির্ভর সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতৃত্বে তারুণ্যের রোডমার্চ শুরু হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুর এই লংমার্চ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি মাসের মধ্যে এটি পর্যায়ক্রমে সাংগঠনিক সব বিভাগে করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। সবশেষ ঢাকায় এই তিন বিভাগের লংমার্চ করার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগ মিলে ঢাকামুখী রোডমার্চের পরিকল্পনা করছে বিএনপি।

 

দলটি ছাত্রদলের নেতৃত্বে বৃহত্তর ছাত্রঐক্য গঠন ও পেশাজীবীদের মাঠে নামাতে জোরালোভাবে কাজ করছে। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনকারীদেরকে মাঠে নামাতে আরো প্রস্তুত করতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। যুগপথের বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামী দল এবং কয়েকটি বাম দল একদফায় যেন জোরালো মাঠে থাকে সে প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে।

 

দলটির একজন যুগ্ম-মহাসচিব ভোরের আকাশকে বলেছেন, প্রথমেই বিচারালয়ের সামনে অবস্থানের মাধ্যমে একদফার হার্ড কর্মসূচির দিকে যেতে চায়। হঠাকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে থাকতে চায়। তবে, বাধা আসলে আর নরম কর্মসূচিতে থাকবে না দল। এক পর্যায়ে ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাও কর্মসূচি’কে বেছে নেবে বিএনপি। চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে। এছাড়া সরকারি অফিস- যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দাবি না মানলে লাগাতার অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচিও দেয়ার পরিকল্পনা আছে বিএনপিতে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করার সিদ্ধান্ত বিএনপির।

 

আন্দোলনে পুলিশি বা হয়রানির গ্রেফতারের বিষয়টি মাথায় রয়েছে বিএনপির। শীর্ষ নেতারা বা সহযোগী সংগঠনের নেতারা গ্রেফতার হলে পরবর্তীতে কারা দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়েও হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে বলে জানা গেছে। শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হলে আন্দোলন যেন থমকে না যায় সেজন্য নেতৃত্বে তিন ধাপের নেতা বাছাই করা হয়েছে বলেও ছাত্রদলের এক নেতা জানিয়েছেন।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে ও দেশের বাইরেও সবাই এখন জানে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন ভিসানীতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ক্রমাগতভাবে বিদেশিরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন। তারা জানে গত দুই নির্বাচনে মানুষ এখানে ভোট দিতে পারেনি।

 

তিনি বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ একদফার আন্দোলনে আছে। সময় বেশি নেই সেটি বিএনপির মাথায় নিয়েই এগোচ্ছে দল। ইতোমধ্যেই মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন ধারাবাহিক কর্মসূচি আসছে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা আন্দোলনে সর্বোচ্চ আন্দোলন করবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version