এম সাইফুল ইসলাম: এবার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেয়ার গুঞ্জন উঠেছে জোরেশোরে। কমিটি ভেঙে দেয়ার পর নতুন আহব্বায়ক কমিটির শীর্ষ পদে আসছেন এমন অনেকের নামও রয়েছে আলোচনায়। অভিভাবক সংগঠন বিএনপি যখন এক দফার আন্দোলনে তখন ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেয়ার গুঞ্জনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
সম্প্রতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতিকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া এবং কমিটি বাণিজ্যের খবর প্রকাশে সংগঠনটি অনেকটাই এখন অগোছালো অবস্থায়। তার মাঝে একটি গ্রুপ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজেদের লোক সামনে আনতে সংগঠনটির কমিটি ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
ছাত্রদলের একাধিক নেতা এই গুঞ্জনের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, কমিটি ভাঙবে কিনা সেটি ছাত্রদলের অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্ভর করবে। তবে, আন্দোলনের মাঝে কমিটি ভাঙার চেষ্টা ভালো উদ্দেশ্য নয়। জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত দলটির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। দলটির সামনে এই আন্দোলন এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে পারলেই দাবি আদায় সম্ভব হবে। অন্যথায় বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আগামী দিনে আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। তাই এখন তাদের সামনে আন্দোলনের বিকল্প নেই।
শুক্রবার দলটির নয়াপল্টন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর এক দফার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তার কথায় স্পষ্ট বিএনপি আগামীতে এক দফার জোরালো আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। দলটি এক দফায় আন্দোলনে যাওয়ার আগে ছাত্রদলের নেতৃত্বে বৃহত্তর ছাত্রঐক্য গঠনেরও চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিএনপি এখন এক দফার আন্দোলনে মাঠে নামতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তারা তাদের পছন্দের লোককে সামনে আনেতই এই চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই গ্রুপটি ইতিপূর্বে সংগঠনটির সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সরিয়ে তাদের পছন্দের জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবালকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছে।
গত ২৯ জুলাই ঢাকার অবস্থান কর্মসূচিতে অবহেলার অভিযোগ এনে দলীয় হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে শ্রাবণকে ‘অসুস্থতার অজুহতে’ সরিয়ে দেয়া হয়। শ্রাবণকে সরিয়ে দেয়ার দুদিন পর ওই গ্রুপটি দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রদলের কমিটির অনুমোদন দেয়। ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করে পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে ওই কমিটি ঘোষণার পর সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ে তালাও দেন পদবঞ্চিতরা। ওই ঘটনার জন্য অনেকটাই ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রক বিএনপির এক নেতাকে দায়ী করে বক্তব্য দিলে সেটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ তার পদে ফিরবেন কি ফিরবেন না এমন প্রশ্নের উত্তর জানার আগ্রহ রয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে। নেতাকর্মীদের মাঝে তারও রয়েছে শক্ত অবস্থান। পাশাপাশি কমিটি বাণিজ্যের খবর প্রকাশেও ছাত্রদলে টালমাটাল অবস্থা। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বে চলছে একদফার সরকারবিরোধী একদফার আন্দোলন। ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপির যে গ্রুপটি ছাত্রদল নিয়ন্ত্রণে তৎপর তারা এবার চলমান কমিটি ভেঙে দিয়ে আহব্বায়ক কমিটি গঠনের চেষ্টা করছেন। সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন নেতার নাম সামনে এসেছে।
বর্তমান সেক্রেটারি সাইফ মাহমুদ জুয়েল বা ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবালকে আহব্বায়ক এবং প্রথম সহ-সভাপতি তানজিল হাসানকে সদস্য সচিব করা হতে পারে। আরেকটি গুঞ্জন রয়েছে, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে আহব্বায়ক ও সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন নাসিরকে সদস্য সচিব করার। কেউ কেউ আবার বলছেন, নাসির উদ্দিনকে আহব্বায়ক করে যুগ্ম-সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে সদস্য সচিব করা হতে পারে। আবার আহবায়ক বা সদস্য সচিবের যেকোনো একটি পদে বর্তমান কমিটির জ্যৈষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবের নামও থাকতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
ছাত্রদল ও বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমান সহ-সভাপতি তানজিল হাসানের বাড়ি পটুয়াখালী। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাসান মামুনের ‘ছোট ভাই’ হিসেবে পরিচিত তিনি। হাসান মামুনের বাড়িও পটুয়াখালী। হাসান মামুনকে রকিবুল ইসলাম বকুলের খুব ঘনিষ্ঠজন বলেই দলের নেতা কর্মীরা জানেন। সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ২০১৬ সালে ছাত্রদলের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে হঠাৎ করে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে আলোচনায় আসেন।
আবু আফসান মূলত ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক এবং ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক থেকে সরাসরি বিএপির দপ্তরে নিয়োজিত (নির্বাহী কমিটির সদস্য) আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারীর লোক হিসেবে পরিচিত। বর্তমান সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন নাসির মূলত আগে ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুর রহমান চৌধুরী আবেদ ও মামুনুর রশীদ মামুন এবং পরে ঢাবি সাংগঠনিক সম্পাদক মিনহাজের লোক হিসেবে পরিচিত। চট্রগ্রামের বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলালের লোক হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক রাকিব সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর লোক হিসেবে বেশিরভাগই জানেন। তবে, ঢাবির আহব্বায়ক হওয়ার জন্য সেসময় তিনি শ্রাবণের দিকে ঝুঁকেছিলেন বলে জানা গেছে।
যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব আমান উল্লাহ আমান একসময় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু গ্রুপের কর্মী ছিলেন। তারপর গত কমিটিতে প্রথমে সভাপতি খোকনের লোক হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। শ্রাবণ জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি থাকাকালীন শ্রাবণের লোক হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। বর্তমানে তিনি আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারীকে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে মানেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের সমর্থকরা ইতোমধ্যে ফেসবুক থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের পছন্দের নেতার পক্ষে লেখালেখিও শুরু করেছেন।
জানা গেছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, ভাইস-চেয়ারম্যান ও যুগ্ম-মহাসচিবদের নিয়ে জৈষ্ঠ নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে চলমান আন্দোলনের মধ্যে নতুন করে কোনো অঙ্গ সংগঠন বা দলের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের কমিটি না করার ব্যাপারে মতামত দেন দুষ্ট নেতারা। এরপরও ছাত্রদলের কমিটি করার জন্য এতো তোড়জোড় কেন তা নিয়ে সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদলের জ্যৈষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিবের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপরগতা প্রকাশ করেন।
সংগঠনটির সহ-সভাপতি নিজাম উদ্দিন রিপন ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে আহব্বায়ক কমিটি করা হবে এমন একটি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু গুঞ্জন তো অনেক সময় গুঞ্জনই থেকে যায়। আমিসহ বেশিরভাগ নেতাই এখন এক দফা আন্দোলনের বাইরে কিছু ভাবছি না।
সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন নাসির ভোরের আকাশকে বলেন, কমিটি ভেঙে দেয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন থাকলেও আসলেই এ গুঞ্জনের কোনো বাস্তবতা আছে কিনা তা তার জানা নেই। তার দাবি, ছাত্রদলের সাংগঠনিক অবিভাবক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই এই বিষয়ে চূড়ান্ত।
সহ-সভাপতি আলমগীর কবীর ভোরের আকাশকে বলেছেন, চলমান কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের আসলে কোনো বাস্তবতা নেই। যারা চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন থেকে ছাত্রদলকে দূর সরিয়ে রাখতে চান বা নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখতে চান তারাই কমিটি ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য