-->
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুতে 

হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম
হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম: দলীয় প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ইস্যুতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি। বিষয়টিতে সরকারের সাড়া না মিললে দলটি সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এবার এই ইস্যুতে কঠোর কর্মসূচির চিন্তা করছে। দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে পরবর্তী কর্মসূচির সিদ্ধান্ত আসবে বলেও জানা গেছে। এদিকে, খালেদা জিয়া ইস্যুতে বিএনপির দেয়া ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হচ্ছে আজ। এ বিষয়ে দলটির পরবর্তী কী কর্মসূচি আসছে সেটি জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে সর্বত্র।

 

দলটির নেতারা বলছেন, সাবেক একজন নারী প্রধানমন্ত্রীকে শুধুমাত্র প্রতিহিংসার কারণে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করছে সরকার। সঠিক চিকিৎসার অভাবে দলীয় প্রধানের কোনো অঘটন ঘটলে আওয়ামী লীগকে দায় নিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এ ইস্যুতে কঠোর কর্মসূচিরও ইঙ্গিত তাদের।

 

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারাবরণ শুরু হয়। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাস শুরুর পর পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে তার দন্ড ৬ মাসের জন্যে স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে তিনি গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় অবস্থান করছেন। প্রতি ৬ মাস পর তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ান হয়।

 

এর মধ্যে ২০২১ সালে তিনি দু’দফা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে আরো একাধিক সমস্যা নিয়ে তিনি কয়েকবার রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ফের ভর্তি হয়ে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭৮ বছর বয়সি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

 

খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের আকাশকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে। যা দেশে সঠিকভাবে সম্ভব নয়। তার নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে তাই মাল্টিপুল ডিসিপ্ল্যানারি সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া জরুরি। লিভার সিরোসিসের কারণে শরীরে পানি জমে যাচ্ছে। এগুলো দুয়েকদিন পরপর বের করা হচ্ছে। দেশে যতটুকু সম্ভব তার সর্বোচ্চ দেয়া হচ্ছে। আর ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হওয়ায় শরীরে দুর্বলতা রয়েছে। এগুলোর উন্নতির চেষ্টা চলছে। স্যুপ ও তরল জাতীয় কিছু ছাড়া তিনি তেমন কিছু খেতে পারছেন না।

 

এরআগে গত বছরের জুনে এনজিওগ্রাম করা হলে খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে তিনটি বøক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন। তার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন মেডিকেল বোর্ড।

 

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দলের চেয়ারপারসন বেমগ খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে, এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে দলটি। যার অংশ হিসেবে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। রোববার বিকেলে নয়াপল্টনে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে ঢাকা মহানগর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মির্জা ফখরুল ছাড়াও দলটির নেতারা ওই আল্টিমেটাম দেন।

 

সমাবেশে মির্জা ফকরুল বলেছেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। চিকিৎসকরা বলেছেন, তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশে আর তার চিকিৎসা নেই। তাকে বিদেশে না নেয়া গেলে বাঁচানো দুষ্কর হতে পারে। এরপর তিনি সমাবেশে কেঁদে ফেলেন। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারকে বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার ব্যবস্থা করতে সময় বেঁধে দেন তিনি। ওই সমাবেশে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে আল্টিমেটাম দেন।

 

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আলোচনা হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এটিকে, সেই আলোচনাকে ফলপ্রসূ করার কৌশল হিসেবেই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিতে পারে বিএনপি। আর সরকার দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির চিন্তা করছেন দলটির নেতারা।

 

ঢাকার এক অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, আর ৩৬ ঘণ্টা সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্যে না পাঠালে সরকারের জন্যে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। এদিকে, বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে এভারকেয়ার হাসপাতালে দলীয় প্রধানকে দেখতে যান দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থ। তার কোনো অঘঠন ঘটলে দায় নিতে হবে সরকারকে। এদিকে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যার যার মোতো করে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে ইতিবাচক কোনোকিছু লক্ষ্য করা যায়নি।

 

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার যদি সাড়া না দেয় তাহলে কী করবে বিএনপি? পরবর্তী কর্মসূচিই কী হবে? আর আল্টিমেটামের সময় পার হওয়ার পর বিএনপি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে মির্জা ফখরুল সে বিষয়ে কিছু বলেননি। তাই সর্বত্র বিষয়টি নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

 

৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামের পর সরকার দাবি না মানলে কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে মহাসচিব একা দেখা করেছেন। সেখানে বিএনপির আমরা অন্য কেউ ছিলাম না। এ আল্টিমেটাম খুবই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সাড়া পাওয়া না গেলে দলের মহাসচিব পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

 

এ বিষয়ে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আল্টিমেটাম এসেছে। এখন দল বসে পরবর্তী কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এতদিন তো সরকার কোনো কথা কানে তোলেনি। আমরা মনে করি সরকার অন্যায় করেছে। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমরা একাধিকবার সেটা করেছি।

 

এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে খালেদা জিয়া ইস্যু নতুন মোড় নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো অবস্থায় নেই দেশ। তিনি কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, নতুন কর্মসূচির ধরণ কী হবে সেটি সময় হলে দেশবাসী দেখতে পারবেন।

 

এদিকে, সোমবার রাতে বিএনপি সর্বোচ্চ নীতি নিধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে। দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, সরকারের চলতি মেয়াদে ক্ষমতার শেষ সময়ে দলীয় প্রধানের মুক্তি ও চিকিৎসার ইস্যুতে আর ছাড় দিতে চান না তারা। কারণ, এখনো খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের কাছে ভরসার আশ্রয়স্থল। এই ইস্যুতে কর্মসূচি না দিলে তৃণমূলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন জ্যেষ্ঠ নেতারা।

 

বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তার একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা আছে। সরকার যদি মানবিক ও আন্তরিক হয় সেক্ষেত্রে অনুমতি দেয়া হতে পারে।

 

বিষয়টি নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হরেচ্ছ। যা দেশ বিদেশে সবাই প্রত্যক্ষ করছেন। তার যদি কোন অঘটন ঘটে উদ্ভুত পরিস্থিতির দায় সরকারকে নিতে হবে।

 

তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই ইস্যুতে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের আস্থার জায়দা দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারের আচরণ নেতাকর্মীরা সহ্য করবেন না বলেও সাফ জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version