-->
শিরোনাম

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অক্টোবর

নিখিল মানখিন
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অক্টোবর

নিখিল মানখিন: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনায় ‘অক্টোবর’ মাস। বিভিন্ন কারণে মাসটি কেন্দ্র করে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট বলে জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

 

অক্টোবরেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অনড় আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের মাস হিসেবে অক্টোবরের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, নানা কারণে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক আগেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক মহলের বিবৃতি ও আচরণ বিশেষ করে মার্কিন ভিসানীতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশিদের আচরণ ও কথাবার্তা বিএনপির দাবিসমূহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে তেমন সফলতার মুখ দেখছে না বিএনপি। আন্দোলনে সফলতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি অনেকটা বিদেশি শক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

 

আর পুরোপুরি নির্বাচনমুখী সরকার দলীয় আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অনড় তারা। এভাবে অক্টোবরে সরকারের পতন ঘটাতে বিএনপি এবং তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দুই দলের মারমুখী অবস্থান জনমনে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।

 

সরকার পতন ঘটনোর লক্ষ্য বিএনপির: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অক্টোবরের মধ্যেই বিএনপি তাদের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নেয়ার কথা বলছে। কারণ, নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। ভোট করতে হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে, এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে।

 

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হবে। তাই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চায় বিএনপি। এমন চিন্তা থেকে যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চ‚ড়ান্ত ধাপে নিতে কৌশল ঠিক করছে দলটি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন বার্তা দেয়া হয়েছে সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীদের। সরকার এবার বিনা চ্যালেঞ্জে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাতে এগোতে না পারে, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বড় অংশ মনে করছে।

 

তবে মাঠের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা টলানো যাবে, সেই সন্দেহও রয়েছে বিএনপির ভেতরে। কারণ, ঢাকায় বড় জমায়েতের মহাসমাবেশ করার পরদিনই গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের জমায়েত সেভাবে ছিল না। দলটির নগণ্যসংখ্যক নেতাকর্মী সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মারমুখী অবস্থানের মুখে মাঠে থাকতে পারেননি। সেই পরিস্থিতি ছিল তাদের জন্য একটা বড় ধাক্কা। এক ধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছিল এবং একটা ছন্দপতন হয়েছিল এক দফার আন্দোলনে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর দলটির নেতৃত্বের একধরনের নির্ভরশীলতার বিষয়ও অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে।

 

বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা পাওয়া তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে অক্টোবরে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। বিএনপির চলমান কর্মসূচি আগামী ৫ অক্টোবর শেষ হবে। এর পর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিক কর্মসূচি দিতে পারে দলটি। সেই কর্মসূচি কেমন হবে তা নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

 

দুর্গাপূজার আগে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত রোড মার্চ, পদযাত্রা, সমাবেশসহ ঢাকাকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চ‚ড়ান্ত আন্দোলনে নেমে যেতে পারে দলটি। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি ধীরে ধীরে সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, সংসদ ভবন, বিচারঙ্গণ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি দিতে পারে। প্রয়োজনে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে বলে ঈঙ্গিত দিচ্ছেন দলীয় নেতারা। অক্টোবরেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

 

গত শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের উদ্যোগে আমান উল্লাহ আমানের মুক্তির দাবিতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যে পথে চলছে তাতে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ প্রতিটি সেক্টরকে তারা ধ্বংস করে ফেলছে। এখন দেশে শান্তি নাই। সব জায়গায় অরাজকতা চলছে। ধ্বংস হয়ে যাবে আওয়ামী লীগ সরকার।

 

কঠোর হস্তে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগের দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির সরকার পতন ঘটানোর আন্দোলন কঠোর হস্তে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবেই দলটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা যদিও মনে করছেন যে বিএনপির আন্দোলন এখনো সরকারের ওপর বড় কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি, কিন্তু তারা এটা বলছেন, বিএনপি নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে নির্বাচন বানচাল করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করবে। আর নির্বাচন না হলে তখন সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। সেই পরিস্থিতিতে সরকার বেকায়দায় পড়বে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এ ধরনের আলোচনা রয়েছে।

 

বিভিন্ন দিকের চাপ ও বাস্তবতা বিবেচনায় সরকারের জন্য এখন নির্বাচনের বিকল্প নেই। সে জন্য অক্টোবরে বিএনপির কর্মসূচিকে প্রশাসনিকভাবে ও রাজনৈতিক দিক থেকে মোকাবিলা করার কথা বলছে আওয়ামী লীগ। দলটি আগেই ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত প্রতিদিন রাজনৈতিক কর্মসূচি রেখে সরকারকে পাহারা দেবে। এখন দলটির নেতারা বলছেন, অক্টোবরে বিএনপি যে কর্মসূচিই দেবে, একই দিনে একই সময়ে তার পাল্টা কর্মসূচি তারা নেবেন। বিরোধী দলের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ না থাকলে তা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা প্রতিহত করবেন।

 

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করবে। তবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ব্যাপারে যেকোনো দল বা মহলের পরামর্শ তারা নেবেন। কিন্তু নির্বাচনবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে তারা কঠোর হবেন।

 

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ অক্টোবর দেশে ফিরবেন। এদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হবে। ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ উপলক্ষে সেখানে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন।

 

বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রোববার বিকেলে দলের যৌথ সভা হয়েছে। তাতে দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন।

 

দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত কর্মসূচির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পরিস্থিতি বুঝে বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হবে। ঢাকা মহানগর ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনা থাকবে আওয়ামী লীগের। প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে।

 

গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে কৃষক লীগ আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শিগগিরই বিএনপির রাজনীতি গোরস্থানে চলে যাবে। আজকের এই কৃষক সমাবেশে দাঁড়িয়ে আমি বিএনপিকে জিজ্ঞেস করতে চাই-৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম কই? ভুয়া আল্টিমেটাম, এক দফা ভুয়া, বিএনপি হচ্ছে ভুয়া, আন্দোলন ভুয়া, ক্ষমতা দখল ভুয়া। প্রস্তুত হয়ে যান, নেত্রী আসছেন।

 

আপনাদের ডাক দেবেন, যখনই ডাক দেবেন রাস্তায় নেমে আসতে হবে। যারা রাস্তা দখল করতে আসবে তাদের খবর আছে। যারা আগুন নিয়ে আসবে তাদের হাত আগুন জ্বালিয়ে দেব, যারা মারতে আসবে তাদের হাত ভেঙে দেব।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version