এম সাইফুল ইসলাম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাত্র এক মাস বাকি থাকলেও এখনো কঠোর কর্মসূচিতে কেন নেই বিএনপি? প্রশ্নটি এখন দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বত্র। জানা গেছে, মার্কিনসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ বিএনপি এখনই কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে সহিংসতা হতে পারে এমন কর্মসূচি পরিহারেও দলটির প্রতি ওইসব দেশের কূটনীতিকদের পরামর্শ রয়েছে।
পাশাপাশি বিএনপি বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনে মার্কিন ভিসানীতি ও পশ্চিমাদের পদক্ষেপও পর্ববেক্ষণ করছে। দলটির নেতাদের ধারণা, একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেবেন পশ্চিমারা। শেষ পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তফসিল ঘোষণার আগে-পরে ‘শর্টটার্ম’ আন্দোলন করে সরকারকে কঠোর চাপে ফেলতেই ধীরে এগোচ্ছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা সঠিক পথেই আছেন। সব সেক্টরের মানুষকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামাতে এখন তারা জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে মাঠে রয়েছেন। বাইরের কূটনীতিকদের পরামর্শে ধীরে চলা নয় দাবি করে তারা বলছেন, সময়মতো তারা সরকারকে ধাক্কা দেবেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এখন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক ধারা রক্ষায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বাইরে ভাবছে না। আর বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। দলটি চায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুাযায়ী, নভেম্বরের শুরুর দিকে তফসিল আর জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে তফসিল ঘোষণার আর মাত্র এক মাস সময় হাতে রয়েছে। দলটি গত কয়েক মাস জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে ১০ দফা ও পরবর্তীতে ১২ জুলাই থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রাজপথে।
দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রয়েছে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি। এই কাতারে সবশেষে সামিল হয় ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দল ও সংগঠন।
সবশেষ ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে দলটির তারুণ্যনির্ভর সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতৃত্বে তারুণ্যের রোড মার্চ শুরু হয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি আগামী ৫ পর্যন্ত অক্টোবর মূল দল ও তার অঙ্গসংগঠনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। যা চলমান। দলটির নিজস্ব কর্মসূচির বাইরেও পেশাজীবী ও ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচি চলছে। সোমবারও দলটির উদ্যোগে ঢাকায় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে সরকার বিএনপির দাবির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান দেখালেও কেন বিএনপি এখনো কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার আর মাত্র এক মাস বাকি থাকলেও দলটি কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ায় তৃণমূলও হাইকমান্ডকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। যা নিয়ে ইতোমধ্যে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপির এই ধীরে চলো নীতির নেপথ্যে আসলে কী রয়েছে?
এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দলটির স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন ভোরের আকাশ এর এই প্রতিবেদক। নাম প্রকাশ না শর্তে তাদের অনেকেই বলেছেন, বর্তমান সরকারের যে কঠোর অবস্থা তাতে আন্দোলনের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামী দেশ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। যেটিতে বিএনপি এখন বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে।
তারা মনে করছেন, র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার উপর মানবাধিকার হরণের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দেশটির ভিসানীতি ঘোষণায় রাজনীতির মাঠে বিএনপি বেশ লাভবান হয়েছে। গত ২৪ মে দেশটির ওই ঘোষণায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি এনে দেয়।
সবশেষ ২২ সেপ্টেম্বর ভিসানীতি কার্যকরে ঘোষণায় বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে আরো চাঙা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে রেজ্যুলেশন পাস হয়েছে। ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। পাশাপাশি আরো অনেকেই এখন সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে না হাঁটলে আগামীতে এসব দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আরো ব্যবস্থা নেবে বলে বিএনপি নেতারা মনে করছেন।
বিএনপি একজন যুগ্ম-মহাসচিব বলেছেন, বিএনপির কর্মসূচি প্রণয়নে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের প্রেসক্রিপশন রয়েছে। আগেভাগেই কোনো প্রকার সহিংস কর্মসূচিতে না যেতে বিএনপিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, সহিংসতামুক্ত সর্বোচ্চ জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি পালনে জোর দেয়া হয়েছে। বিএনপি এখন সে পথেই হাঁটছে। গত কয়েক মাস থেকে বিএনপি চোখে পড়ার মতো বড় বড় সমাবেশ করেছে। এছাড়া বিএনপি এমন কোনো কর্মসূচিতে যেন না যায় ক্ষমতাসীনরা দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলার সুযোগ পায়। পাশাপাশি বিএনপি মার্কিন ভিসানীতির বিষয়টিকে মাথায় রেখে ধীরে চলছে।
তবে, শেষপর্যন্ত বিএনপি কঠোর আন্দোলন করবে। আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত যে কর্মসূচি রয়েছে সেটি শেষ হলে ফের দলটি ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে। সেই কর্মসূচিতে ঢাকায় যুব ও ছাত্র কনভেনশনের পাশাপাশি সভা সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। ১৮ অক্টোবর বা তার আগে দলটি ঢাকায় একটি বড় সমাবেশ করে সরকারকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিতে পারে। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দলটি আগামী ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর বিএনপি বিশেষ কোনো কর্মসূচি রাখবে না। পূজার পর দলটি লাগাতার মাঠে নামবে বলেও জানা গেছে।
তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে ফাইনাল রাউন্ডের আন্দোলনে ‘শর্টটার্ম’ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। পূজার পর দলটি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার মাঠে থাকার চিন্তা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সরকার পদত্যাগের এক দফার পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসায় যেতে না দেয়া ইস্যুও আন্দোলনে গতি বৃদ্ধি করবে বলে নেতাদের ধারণা।
চূড়ান্ত দাবি আদায়ে দলটি সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে। এছাড়া সরকারি অফিস- যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে।
এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দাবি না মানলে লাগাতার অবরোধ বা হরতালের মতো কর্মসূচিও দেয়ার পরিকল্পনা আছে বিএনপিতে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ করার সিদ্ধান্ত বিএনপির।
আর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশ কে বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। আন্দোলন চলছে, যথাসময়ে আন্দোলনের ধরন পরিবর্তনে গতি বৃদ্ধি করা হবে। বিএনপি কর্মসূচি প্রণয়নে বাইরের কারো পরামর্শ নেয়ার বিষয়টিকে তিনি ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেছেন, দল হিসেবে বিএনপির একটা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে। মানুষের চাওয়া অনুযায়ী দলের সর্বোচ্চ ফোরাম কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে অন্য কারো পরামর্শ নেয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। দল আন্দোলনে আছে। সামনে দাবি মানার জন্যে সবধরনের আরো কর্মসূচি আসবে।
তার দাবি, বাংলাদেশে যে ভোট চুরির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটি এখন দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। যার বড় প্রমাণ মার্কিন ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা। বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের পদক্ষেপ ইতিবাচক।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য