নিখিল মানখিন: বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন করবেই আওয়ামী লীগ। কোনো ধরনের নির্বাচন হবে, এখন এটাই চূড়ান্ত হওয়ার বাকি রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সকল দলের অংশগ্রহণে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। মূল বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে আংশিক বিএনপি নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। মূল ও আংশিক বিএনপি না এলে অংশগ্রহণে আগ্রহী দলের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হবে নির্বাচন। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের উপস্থিতিতে নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। নির্বাচন নিয়ে বিতর্কে জড়ানোর চেষ্টা করবে না আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই পাল্টে যাচ্ছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে যাবে আওয়ামী লীগ। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচন বয়কট করবে বিএনপি। এমনতাবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী বিএনপি নেতাদের শেষ আশ্রয়স্থল উঠতে পারে তৃণমূল বিএনপি। তবে বিএনপির এক দফা আন্দোলনের গতি প্রকৃতির ভিত্তিতে সৃষ্টি হতে পারে রাজনীতির ভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং পাল্টে যেতে পারে নির্বাচনের ধরন।
সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করে তোলার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষ করে পশ্চিমাদের প্রবল চাপ রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ভিসানীতির বাস্তবায়ন শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন।
গত সোমবার যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় দলের সদস্যরা (এপিপিজি) লন্ডনে তার অবস্থানস্থল তাজ হোটেলে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে হবে। কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা দখল করতে পারবে না বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
পশ্চিমাদের চাওয়া এবং আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটলে নির্বাচন যে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেই নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ করে পশ্চিমা দেশগুলোর অনুরোধে বা রাজনৈতিক সমঝোতার পক্ষে তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সবধরনের সংকট থেকে মুক্তি পাবে। সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন হবে না, বিতর্ক হবে না।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন যে ২০১৪ বা ২০১৮-এর মতো হবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এ রকম নির্বাচন হলে নির্বাচনে যারাই জিতুক না কেন সেই সরকার আন্তর্জাতিকভাবে সহজে স্বীকৃতি পাবে এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এটি হবে একটি নতুন মাইল ফলক। কিন্তু এভাবে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারপরও কথা থাকে, যদি শেষ পর্যন্ত অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনও হয় সেই নির্বাচন পরাজিতরা কতটুকু মেনে নেবেন তা দেখার বিষয়ও রয়েছে।
নির্বাচনের পরে কারচুপির অভিযোগ বা অন্যান্য অভিযোগ আনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি চিরায়ত রীতি। সেই রীতি পাশ কাটিয়ে এই ধরনের নির্বাচনকে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশে আদৌ চালু হবে কিনা তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। নানা প্রতিকূলতা থাকলেও সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির আংশিক অংশগ্রহণে নির্বাচন: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন করবেই আওয়ামী লীগ। আর বিএনপিকে খন্ড বিখন্ড করার চেষ্টাও করবে তারা। এটাও এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। সব দেশেই এমন কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। হামলা ও মামলার শিকার হচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন সফল না হলে তাদের মাঝে নেমে আসবে হতাশা-নিরাশা। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বেন তারা। আরও পাঁচ বছর সরকারি বিরোধী অবস্থানে মাঠে সক্রিয় থাকতে পারবেন না এমন নেতাকর্মীর সংখ্যাও কম হবে না। তাদের কেউ কেউ হয়ে যাবেন নিষ্ক্রিয়। অনেকে বিকল্প দলের হয়ে অংশগ্রহণ করবেন নির্বাচনে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী বিএনপি নেতাদের সংখ্যাও লম্বা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলেন, নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সংসদে সম্ভাব্য বিরোধী দলের বিষয়টি এবার আলোচনায় উঠে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে যাবে আওয়ামী লীগ। এতে নির্বাচন বৈকট করবে বিএনপি। বিএনপির প্রথম ও দ্বিতীয় সারির অনেক নেতা আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবেন আলোচনা রয়েছে।
তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানকারী বিএনপি নেতার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। যোগদানকারী প্রথম সারির বিএনপি নেতার সংখ্যা বাড়তে থাকলে সার্বিক অবস্থা এবং আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্বের বিবেচনায় তৃণমূল বিএনপির পেছনে চলে যাবে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) অবস্থান। ইতোমধ্যে ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে তৃণমূল বিএনপি।
চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর শমসের মবিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান মেনে নির্বাচনে যাব আমরা। আমাদের বিশ্বাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, প্রশাসনসহ অন্যরা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে জনগণের প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।
৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়া প্রশ্নে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে কেবল যাত্রা শুরু করলাম। অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। যারা যোগাযোগ করছেন, তারা নিজ নিজ এলাকায় কতটা জনপ্রিয় তা যাচাই-বাছাই করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আশা করছি নির্বাচনের আগেই আমরা আমাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারব বলে জানান শমসের মবিন চৌধুরী।
এদিকে, সম্প্রতি সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আরও অনেকে বিএনপি থেকে পালিয়ে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেবে। বিএনপিতে মূল্যায়ন না হওয়া এবং নির্বাচনের সুযোগ না থাকায় অনেক নেতা দলছুট হতে পারে। ভোটে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপির এখনকার বক্তব্য আর এক মাস আগের বক্তব্যের পার্থক্য আছে। বিএনপি ২০১৮ সালেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে এসেছিল। এবার কি করে সেটা দেখার অপেক্ষায় মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকার চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক।
কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে জেতার গ্যারান্টি চায় বলে অভিযোগ করেন তথ্যমন্ত্রী বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা অভিযোগ করে যাচ্ছেন, বিএনপিকে ভাঙার চক্রান্ত চলছে এবং বিএনপির মধ্যে মীরজাফর তৈরি করা হচ্ছে। এ রকম আংশিক বিএনপির অংশগ্রহণে যদি নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন যদি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয় তাহলে পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই কম হবে বা শেষ পর্যন্ত তারা এই নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণ করবে।
নির্ভর করছে সেই নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকায় কি হয়, নির্বাচন কতটা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয় এবং এ ধরনের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি কেমন হয়। সবকিছু মিলিয়ে এ ধরনের একটি নির্বাচন মন্দের ভালো। এই ধরনের নির্বাচনের পর শেষ পর্যন্ত হয়তো সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন কোনো সংকট দেখা দেবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনে সফলতা না পেলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে যাবে আওয়ামী লীগ। দলটির কাছে গুরুত্ব কমে যাবে বিএনপির। এক্ষেত্রে এমন একটি সম্ভাবনাও রয়েছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ করলো না, বিএনপির খন্ডিত অংশও অংশগ্রহণ করল না সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে যে সমস্ত দল নির্বাচনে যাবে তাদেরকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে।
এই ধরনের নির্বাচনের করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচনে যেন ভোটার উপস্থিতি ৫০ ভাগ বা তার বেশি থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এই নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করতে হবে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করতে হবে। তারপরও এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা তা অনিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত এই ধরনের নির্বাচন যদি হয় তাহলে নির্বাচনের পরে সরকারকে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দাবি একটাই সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে, কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। অক্টোবরের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটানো হবে। এই সরকারের ঘণ্টা বেজে গেছে। ওদের যেতে হবে, এটাই শেষ কথা বলে জানিয়ে দেন বিএনপি মহাসচিব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নিশ্চিন্তে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় আসতে তেমন বেগ পেতে হবে না। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে সারাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য