-->

দিল্লি হয়ে ওয়াশিংটনে আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন
দিল্লি হয়ে ওয়াশিংটনে আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন: আওয়ামী লীগেই আস্থা ভারতের। আর এই মধুর সম্পর্কই আওয়ামী লীগকে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। আবার ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কিন্তু ভারতের দুই বন্ধু বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। এক্ষেত্রে এই দুই দেশের সম্পর্কের আরো উন্নয়ন এবং অস্বস্তি দূরীকরণে আন্তরিক ভূমিক রাখছে ভারত। ভূ-রাজনীতির যেকোনো ব্লকই হোক না কেন, ভারতকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশের ওপর হস্তক্ষেপ করে বেশি সুবিধা করতে পারবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

গত সোমবার সাভারের আমিন বাজারে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আছে। আমরা দিল্লির সঙ্গে আছি। কোথায় স্যাংশন, কোথায় ভিসানীতি, তলে তলে সবার সঙ্গে আপস হয়ে গেছে। নির্বাচন হবে, খেলা হবে। অক্টোবর থেকে খেলা শুরু। আগামী মাসে সেমিফাইনাল, জানুয়ারিতে ফাইনাল। প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের মাধ্যমে ভারসাম্য করে ফেলেছেন। আর কোনো চিন্তা নেই। নির্বাচন হবে। যথাসময়ে শেখ হাসিনার অধীনেই হবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক বিকাশ, রাজনৈতিক পরিপক্বতা, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গুরুত্ব বাড়ছে বাংলাদেশের। বঙ্গোপসাগর তথা বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। আবার এ অঞ্চলের তিনটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সমীকরণ এবং ওই তিন বৃহৎ শক্তির নিজেদের মধ্যকার জটিল সমীকরণের মাঝখানে রয়েছে বাংলাদেশ।

 

ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও বিশেষ সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অধিকারভিত্তিক ইস্যুতে অস্বস্তিকর সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আসন্ন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিন বৃহৎ শক্তির অবস্থান জনসম্মুখে ক্রমাগত প্রকাশিত হচ্ছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে শেখ হাসিনার নেয়া অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য করা হয় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। আবার একই দিন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজরদের মধ্যে দিল্লির বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ওয়াশিংটনকে অনুরোধ জানানো হয়। গোটা বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বিশেষজ্ঞদের মতে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির একটি থিয়েটারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, কূটনীতিতে কৌশলগত পদক্ষেপ এবং এর পাল্টা পদক্ষেপ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজরদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার বিষয়টি যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে-এটি স্বাভাবিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ বলে মনে হয়। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের প্রভাব বলয় বাড়াতে চায় এবং একইসঙ্গে এখানে ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয় থাকাটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

 

সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এখানে মনে রাখতে হবে কূটনীতি স্থবির নয়, বরং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। যেকোনো সম্পর্ক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা পায় এবং এটিই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত।

 

ভারত-বাংলাদেশ: বাংলাদেশ ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এই বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ভারতের নিরাপত্তার জন্য বারবার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় না দেয়ার বিষয়ে ‘ জিরো টলারেন্স’ দেখিয়ে আসছে বর্তমান সরকার। এর বাইরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদীদের প্রশয় দিয়ে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার’ প্রতি ভারত বহু বছর ধরে যে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে তা আগামী দিনেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেশ কিছু কারণে আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে ভারত সরকার। শুধু বিজেপি নয়, এমনকি ভারতে যদি ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়, যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকেই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে।

 

ভারত এখনো মনে করে, আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে যারা ক্ষমতায় আসবে- তারা এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লালন-পালন এবং প্রশ্রয় দিতে পারে। ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো বলেন, ভারত মনে করে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদ এবং জঙ্গিদের বিস্তার ঘটবে। তারা বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। এই বাস্তবতাতেই তারা আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প ভাবতে পারছে না।

 

আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের অ্যাডভোকেসি: বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা ভারত ও আমেরিকা কারো পক্ষেই সুখকর হবে না বলে মনে করে নয়াদিল্লি। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার বর্তমান ভূমিকায় ভারত যে খুশি নয়, ওয়াশিংটনকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে সেই বার্তাও। একাধিক স্তরের বৈঠকে বাইডেন প্রশাসনকে এ কথা জানিয়েছে নয়াদিল্লি। সূত্রের বরাতে এ খবর জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।

 

আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ হেরে গেলে বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে ভারতীয় ম্যাগাজিন ফ্রন্টলাইন। দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু পরিচালিত ইংরেজি ম্যাগাজিনটির অনলাইন সংস্করণে গত ২০ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সম্ভবত একমাত্র নির্ভরযোগ্য অংশীদার হলো শেখ হাসিনার সরকার।

 

এদিকে, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে ভারতে অনুষ্ঠিত জি-টুয়েন্টি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে সুউচ্চ মর্যাদা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাতে আয়োজক ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি এই জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল সম্মান। শুধু তাই নয়, জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের ঠিক আগের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিনজন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।

 

তারা হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ কুমার জগন্নাথ। এতে বোঝা যায়, ভারতের কাছে শেখ হাসিনার গুরুত্ব ও সম্মান কতটুকু। বাইডেনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ।

 

সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে হাসিনা-বাইডেন আলোচনা: হোয়াইট হাউস ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন গুরুত্ব পায় বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি।

 

সোমবার হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

 

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে অপর এক প্রশ্নে জন কিরবি বলেন, নয়াদিল্লিতে তারা (শেখ হাসিনা ও বাইডেন) জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়।

 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যেখানে তারা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।

 

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক দেশি-বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সামাল দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছর জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক ও কিছু বিষয় নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের সরকারবিরোধী অবস্থান যেন আরো সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক ঘটনায় প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়েছেন তারা। বিদেশি কূটনীতিকদের জোরালো সরকারবিরোধী অবস্থান যেন বিএনপির জন্য আশীর্বাদ ও সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে গিয়েছিল।

 

নতুন যোগ হয় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস প্রসঙ্গ। তার পক্ষ অবলম্বন করে শতাধিক নোবেল বিজয়ীর খোলা চিঠি এবং সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে রয়েছে রাজনীতির গন্ধ। সব মিলিয়ে বিদেশ কূটনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। এমন সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কূটনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে প্রতিবেশী দেশ ভারত।

 

এদিকে, তলে তলে আপস হয়ে গেছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরাও আছি- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দিল্লি আছে, আমরাও আছি, আমরা আছি দিল্লিও আছে? কি বুঝাতে চাইছেন, দিল্লি আপনাদের জানিয়েছে, এভাবে অপকর্ম করতে থাকো, দিল্লি কি বলে দিয়েছে দরকার নাই নির্বাচনের? দিল্লি কি বলে দিয়েছে জোর করেই নির্বাচন ঘোষণা করে দাও? তাহলে পরিষ্কার করে বলেন?

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version