এম. সাইফুল ইসলাম: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রকৃতপক্ষে অংশগ্রহণমূলক করতে বর্হিবিশ্বের তৎপরতাকে নিজেদের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে মার্কিন ভিসানীতিসহ পশ্চিমাবিশ্ব এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারকে অনেকটাই চাপে রেখেছে।
এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সোচ্চার থাকলেও এবার দেশটির কৌশলগত নীরবতা বিএনপির জন্যে ইতিবাচক। দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে না নিয়ে একতরফা ভোটের দিকে হাঁটলে সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধিতে দলটি এখন আরো সক্রিয়। বিএনপি মহাসচিবসহ এই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা প্রায় প্রতিদিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি পর্দার অন্তরালেও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে দলটির নেতাদের।
বিএনপি নেতারা বলছেন বাংলাদেশের মানুষ এখন ভোট দিতে পারে না এটি দেশ ও দেশের বাইরে সবাই জানেন। বর্হিবিশ্বেও এখন এদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। ওইসব দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বিএনপি বর্তমান চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে আন্দোলনের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামীদের তৎপরতা বৃদ্ধিতে তারা জোরালো কর্মকান্ড চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার বাকি রয়েছে আর মাত্র কয়েকদিন। নভেম্বরের প্রথম বা মাঝা-মাঝি সময়ে তফশিল ঘোষণার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বাইরে ভাবছে না। আর বিএনপি দল নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে। চলমান এই অবস্থার মধ্যে বিদেশি তৎপরতা বেড়েছে। প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে বিদেশিদের তৎপরতা বাড়লেও এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন।
কারণ, এবার পশ্চিমাদেশ মার্কিনসহ ইইউ এবং উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করছেন। এসব দেশ বা সংস্থার প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দলের নেতাসহ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। তারা বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। বর্হিবিশ্বের এসব তৎপরতার অংশ হিসেবে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার হরণের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর গত ২৪ মে দেশটি বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে ভিসানীতি ঘোষণা করে। তাদের এই ঘোষণায় রাজনীতির মাঠে বিএনপি বেশ লাভবান হয়েছে। ওই ঘোষণায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি এনে দেয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসানীতি কার্যকরে ঘোষণায় বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে আরো চাঙা হয়েছে। এছাড়া গত ১৫ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে রেজুলেশন পাস হয়েছে। ইইউ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। পাশাপাশি আরো অনেকেই এখন সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। এছাড়া গত দুইবারের নির্বাচনে প্রতিবেশী ভারত সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে সোচ্চার থাকলেও দেশটি এবার অনেকটাই নীরব। এখন পর্যন্ত পশ্চিামারা সরাসরি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বললেও ভারতকে নিশ্চুপ দেখা গেছে। এটিকে বিএনপি কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
সূত্র জানায়, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে না হাঁটলে আগামীতে পশ্চিমাদেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যেন আরো ব্যবস্থা নেয় সে ব্যাপারে বিএনপি নেতারা জোরালোভাবে কাজ করছেন। তারা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন কূটনীতিকদের সঙ্গে। দেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত জানাচ্ছেন কূটনীতিকদের। ঘটনার স্বপক্ষে সব ধরনের প্রমাণাদিও কয়েকটির দেশের হাইকমিশনে পাঠান বিএনপি নেতারা।
জানা গেছে, প্রায় প্রতিদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির বিদেশবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিদেশবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদসহ এই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেন। আমির খসরু ও শামা ওবায়েদ বেশিরভাগ বৈঠক উপস্থিত থাকলে বিশেষ বৈঠকগুলোতে মহাসচিব অংশ নেন। প্রকাশ্যে বৈঠকের পাশাপাশি পর্দার অন্তরালে কূটনৈতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এসব নেতারা।
বিএনপি নেতাদের ভাষ্যমতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে সরকার বর্হিবিশ্বের বেশ চাপে আছে। নিকট অতীতে বর্তমান সরকার এ ধরনের চাপে পড়েনি। বাংলাদেশের গত দুই বার অর্থাৎ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ত্রুটি পূর্ণ নির্বাচনের কথা বিএনপি বাইরের দেশের প্রতিনিধিদের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বর্হিবিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখন জানেন বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার সঙ্কুচিত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে হারহামেশা।
দলের কূটনীতিক উইং এক্ষেত্রে বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। লন্ডনে অবস্থানরত ধরটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিশেষ ভ‚মিকা রেখে চলেছেন বলে জানিয়েছেন দলের নেতারা। তিনি পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়াও ভারতকে আস্থায় আনতে সব ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, বিএনপির কূটনীতিক বিভাগের একসময়কার দায়িত্ব পালনকারীদের এখন বেশিরভাগ অনুপস্থিত। তুখোড় ওইসব নেতারা কেউ বিএনপি ত্যাগ করেছেন। কেউ আবার দল ত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। অনেকে নানাবিধ চাপের কারণে এখন অনেকেটাই নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। এমন তালিকায় অনেকেরই নাম রয়েছে। ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর গুলশানে গুলিবিদ্ধ হন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান। বিএনপির বিদেশ লবিংয়ে খুব নির্ভরযোগ্য রিয়াজ রহমান ওই ঘটনার থেকে নিষ্ক্রিয় বলা চলে। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। কূটনৈতিক কর্মকান্ডে দক্ষ মবিনের পদত্যাগে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন তখন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সিলেট থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপি নেতা ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন বিএনপি কূটনৈতিক বিভাগে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর দল ত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খান।
কূটনৈতিক বিভাগে দক্ষ দলটির চেয়ারপারসেনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদও বয়সজনিত কারণে এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে সদস্য করা হয়েছে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে। এক সময় কূটনৈতিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে সরব উপস্থিতি ছিল মিলনের। এছাড়া একসময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকে থাকলেও তাকে এখন কম দেখা যায়।
একসময়কার কূটনৈতিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নানা কারণে নিষ্ক্রিয় হওয়ায় মাঝে বেশ কিছুদিন এ বিভাগে দলটির কর্মকান্ডে স্থবিরতা ছিল। সেটি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বিএনপি। দলটির এই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এখন যথেচ্ছ সোচ্চার।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিদেশবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশ কে বলেন, বাংলাদেশে যে এখন ভোটাধিকার যেন সেটি এখন দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। যার বড় প্রমাণ এদেশের জন্যে মার্কিন ভিসানীতি। বিএনপি কূটনৈতিক উইং এখন যথেষ্ট সোচ্চার। বিদেশিরা নিজেরাই দেখছেন। পাশাপাশি আমরা সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি দেশের বর্তমান চিত্র।
তিনি বলেন, ফের একতরফা ভোট করার জন্যে শেখ হাসিনা আবারো নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রকামী দেশবাসী পাশাপাশি বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সেটি আর বাস্তবায়ন হতে দেবে না।
স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বাংলাদেশে গুম, খুন, বিচারহীনতা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে ক‚টনৈতিকদের অবহিত করা থেকে শুরু করে সব ধরনের তৎপরতা বিএনপি চালাচ্ছে।
বিদেশে অবস্থানররত বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, মার্কিন ভিসানীতি যেমন দেশবাসীর জন্যে ইতিবাচক। পাশাপাশি সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে সোচ্চার না থেকে প্রতিবেশী ভারতের নিরবতাও ইতিবাচক বার্তা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য