-->
শিরোনাম

ত্রিমুখী সংঘর্ষে রাজধানী রণক্ষেত্র

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান
ত্রিমুখী সংঘর্ষে রাজধানী রণক্ষেত্র

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান: একদিকে ইট-পাটকেল। অন্যদিকে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ডগ্রেনেড। চারদিকে ধোঁয়ায় অন্ধকার। এরমধ্যে সড়কে জ¦লছে আগুন। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্নস্থানে। এভাবেই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছিল রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানী। শুরুটা কাকরাইলে।

 

তারপর পল্টন, শান্তিনগর, আরামবাগ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। শুরুতে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় বিএনপি-পুলিশের মধ্যে। একপর্যায়ে তা পরিণত হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষে। যোগ দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কাকরাইলে পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষের পরপর পুলিশ নয়াপল্টনের সমাবেশে ধাওয়া দেয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা নয়াপল্টন এলাকা ছেড়ে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে যায়। পুলিশ তখন বিভিন্ন অলিগলিতেও টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।

 

একপর্যায়ে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয় পুরানাপল্টন, সেগুনবাগিচা ও দৈনিক বাংলা এলাকায়। এসময় ইটের আঘাতে পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত হন। আহত হন পুলিশের প্রায় শতাধিক সদস্য। অন্যদিকে, বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে বেশ কয়েক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। একজন সংবাদকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এদিকে, সমাবেশে পুলিশের ‘হামলার’ অভিযোগে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আজ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি।

 

সংঘর্ষ চলাকালে বিকালে বিএনপি নেতককর্মীরা স্লোগান দিতে দিতে দৈনিক বাংলার দিকে এগিয়ে যান। সেখানে আগে থেকে শতাধিক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এসময় লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে পুলিশ। এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা। তখন বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয় পুলিশ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটে। এসময় ইটের আঘাতে সড়কে পড়ে যান এক পুলিশ কনস্টেবল। ওই সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। পরবর্তীতে সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত কনস্টেবলের নাম আমিরুল ইসলাম। তিনি মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার সেকেন্দার আলী মোল্লার ছেলে।

 

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কে এন রায় নিয়তি জানান, সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তারিক জানানো হবে।

 

দুপুর আড়াইটার দিকে সংঘর্ষের সূত্রপাত রাজধানীল কাকরাইল এলাকা থেকে। তার আগে পূর্বঘোষিত সমাবেশ উপলক্ষে সকালেই ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়ো হন। পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ ওই এলাকায় সমাবেশ করে। আরামবাগ এলাকায় সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামি।

 

অন্যদিকে, বায়তুল মোকাররম এলাকায় চলছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশ। কাকরাইল এলাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস যখন চাচ্ছিল তখন এতে বাধা দেয় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। বেশ কয়েক গাড়িও ভাঙচুরও করে তারা। এসময় বাধা দেয় পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে লাঠিচার্জ করে। এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তারা। শুরু হয় সংঘর্ষ। রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এসময় পুলিশ দুটি বক্সে অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রধান বিচারপতির বাস ভবন লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে কয়েক জনকে। অগ্নিসংযোগ করা হয় কাকরাইলে আইডিবি ভবনে।

 

আশপাশের ব্যানার, সাইনবোর্ড ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বিএনপির কর্মী সমর্থকরা। পুলিশের ধাওয়ার শিকার হয়ে তারা ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের সদরদপ্তর ও নয়াপল্টনের দিকে পিছু হটে। ওই এলাকায় দীর্ঘ সময় পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। একপর্যায়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুড়ে বিএনপির সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায় পুলিশ। নাইটেঙ্গেল মোড়ে বিএনপির কর্মী সমর্থকদের হামলায় বেশ কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হন। সমাবেশস্থল নয়াপল্টন থেকে নেতাকর্মীরা বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে যান। অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায় নয়াপল্টনের মূল সড়ক। রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে জ্বলে টায়ারের আগুন। এসময় রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

 

বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাফি আল ফারুক জানান, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।

 

পুলিশের টিয়ারগ্যাস ও রাবারবুলেটের শিকার হয়ে শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, ফকিরাপুলের গরমপানির গলি, পল্টনের কালভার্ট রোডসহ বিভিন্ন রোডে অবস্থান নেয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত এরকম বিভিন্ন গলি থেকে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এসময় ত্রিমুখে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

 

বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে তাদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেক করা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর সংঘর্ষ থেমে গেলেও রাজধানীবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। আতঙ্কে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না কেউ। এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সমাবেশগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে করার কথা ছিল। কিন্তু তা ভঙ্গ করে হঠাৎ করে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রথমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। তারা কাকরাইলে আইডিইবি ভবনে আগুন দিয়েছে। চিফ জাস্টিজের ভবনে ভাঙচুর করেছে। একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে।

 

সংঘর্ষের পর বিজিবির সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। বেশ কয়েক গাড়ি নিয়ে বিজিবি সদস্যদের পল্টন, বিজয়নগর এলাকায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে। বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, কাকরাইলের সংঘর্ষের পর সেখানে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের সঙ্গে ছয় প্লাটুনি বিজিবি সদস্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্যকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে তারা রাস্তায় নামবে।

 

সন্ধ্যায় বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় হতাহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ছাত্রদল নেতারা নৃশংসভাবে পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তারা সমাবেশের নামে সন্ত্রাসী করেছে। বিএনপি আজ হরতাল ডেকেছে। তারা গাড়ি পোড়াচ্ছে। তিনি বলেন, যারাই রাস্তায় গাড়ি পোড়াবে, অবরোধ করবে, ভাঙচুর করবে, অগ্নিসংযোগ করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

 

রাজধানীতে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে কাকরাইল, মালিবাগ ও কমলাপুরে এসব ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানান, বিকেলে মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা বাসে ও কমলাপুরে বিআরটিসি বাসে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছে।

 

সংঘর্ষের শেষ দিকে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে কাকরাইল, মালিবাগ ও কমলাপুরে এসব ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিকেলে মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা বাসে ও কমলাপুরে বিআরটিসি বাসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।

 

সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন, ঢাকা টাইমসের সিরাজুম সালেকীন, দৈনিক কালবেলার রাফসান জানি, নিউ এইজের আহমেদ ফয়েজ, বাংলা ট্রিবিউনের সালমান তারেক শাকিল, গ্রিন টিভির বিশেষ প্রতিনিধি রুদ্র সাইফুল্লাহ ও ক্যামেরাম্যান আরজু, ব্রেকিং নিউজের কাজী ইহসান বিন দিদার, আহসান হাবিব সবুজ, ইনকিলাবের ফটোসাংবাদিক এস এ মাসুম, ইত্তেফাকের আবু নাসের, বাংলানিউজের জাফর আহমেদ, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জেএ (আইপি) টিভির ক্যামেরা পার্সন খোকা শেখ, রিপোর্টার রবিন, ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক মারুফসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। এদের মধ্যে সিরাজুম সালেকীনকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়া হয়েছে।

 

রাফসান জানি, খোকা শেখ, রবিনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। অন্যান্য আহত সাংবাদিকরা আশপাশের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন বলে জানা গেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version