নিখিল মানখিন: আওয়ামী লীগের অনুকূলে দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি! আন্তর্জাতিক চাপ এবং বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সফলতা পাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে আন্দোলনকারী বিএনপি ও তাদের জোটের শরিকদলগুলোর নেতাকর্মীরা। আর আন্দোলনের নামে তাদের জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসে বিব্রত বিদেশিরা। আন্দোলনকারীদের পক্ষে জোর গলায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। আর গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে গেছেন অনেক বিএনপি নেতাকর্মী। ফলে ফাঁকা রাজনৈতিক মাঠে নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের শেষ দিকে এসে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপিকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনার পর পাল্টে গেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ‘বিদেশি চাপ’ উপেক্ষা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে দৃশ্যত মনে করা হচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় রাজনৈতিক সংঘাতের পর থেকে একদিকে বিরোধীদল বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় করা হচ্ছে, অন্যদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মাসের মাঝামাঝিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগাদা দেয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি সেটি নাকচ করে দিয়েছেন।
বিদেশি কূটনীতিকদের বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে আগে যুক্তরাষ্ট্র যে রকম আগ্রাসী এবং সতর্ক ছিল সেই জায়গা থেকে তারা সরে এসেছে। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরের রাজনীতির পর তারা কিছুটা বিব্রত এবং হতাশ।
তবে শুধুমাত্র বিএনপির ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ নয়, আরো নানা রকম কূটনীতিক প্রভাবের কারণেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অবস্থান কতটা পরিবর্তন করছে বা আদৌ করেছে কিনা তা বোঝা যাবে আগামী ১০ নভেম্বর। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøঙ্কেনের বৈঠক হবে। এছাড়াও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও নয়াদিল্লিতে এসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। এ আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছেন।
গত শুক্রবার জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশিদের লাফালাফিতে এদেশে নির্বাচন বানচাল হবে না। নির্বাচন সঠিক সময়েই হবে। সামনে নির্বাচন। বহু ষড়যন্ত্র হবে নির্বাচন বানচালের। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ভোটের প্রস্তুতি নিতে হবে। যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। অগ্নিসন্ত্রাসীরা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করতে চাইলে তাদের রুখে দাঁড়ানোর আহব্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
গত শনিবার অগ্নিসন্ত্রাস রুখে দেয়ার আহব্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা আগুন দিয়ে পোড়াবে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। দরকার হলে তাদের ধরে ওই আগুনের মধ্যে ফেলতে হবে। যে হাত দিয়ে আগুন দেবে সেই হাত আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই তাদের শিক্ষা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
কঠোর হস্তে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগের দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির সরকার পতন ঘটানোর আন্দোলন কঠোর হস্তে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবেই দলটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা যদিও মনে করছেন যে বিএনপির আন্দোলন এখনো সরকারের ওপর বড় কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি, কিন্তু তারা এটা বলছেন, বিএনপি নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে নির্বাচন বানচাল করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করবে। আর নির্বাচন না হলে তখন সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। সেই পরিস্থিতিতে সরকার বেকায়দায় পড়বে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এ ধরনের আলোচনা রয়েছে।
বিভিন্ন দিকের চাপ ও বাস্তবতা বিবেচনায় সরকারের জন্য এখন নির্বাচনের বিকল্প নেই। সে জন্য বিএনপির কর্মসূচিকে প্রশাসনিকভাবে ও রাজনৈতিক দিক থেকে মোকাবিলা করার কথা বলছে আওয়ামী লীগ। দলটি আগেই ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত প্রতিদিন রাজনৈতিক কর্মসূচি রেখে সরকারকে পাহারা দেবে।
এখন দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি যে কর্মসূচিই দেবে, একই দিনে একই সময়ে তার পাল্টা কর্মসূচি তারা নেবেন। বিরোধীদলের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ না থাকলে তা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা প্রতিহত করবেন। গত ২৮ অক্টোবর এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপি জোটের হরতাল ও অবরোধসহ প্রতিটি কর্মসূচি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের সফলতার চিত্র বেশ লক্ষ্যণীয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনী আবহ: দেশে তৃণমূল পর্যায়ে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আবহ। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখরিত থাকছে পথ-প্রান্তর। ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে এলাকা। প্রতিদিন চলছে শোডাউন, পথসভা ও উঠান বৈঠক। একটি নির্বাচনী এলাকায় আট থেকে দশজন মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় জমে উঠেছে নির্বাচনী জনসংযোগ।
এদিকে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরমের দাম ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। একাদশ নির্বাচনে মনোনয়ন ফরমের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা, যা এবার করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
রোববার দুপুরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি জানান, ‘আটটি বুথে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা ও জমা দেয়া যাবে। মনোনয়নপত্রের মূল্য ৫০ হাজার টাকা। এবার কেউ অনলাইনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে চাইলে করতে পারবেন। তবে কবে থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা যাবে, সেটা পরে জানাব।’
ওবায়দুল কাদের জানান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি এবং জমা নেয়া হবে। আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি। আবার কেউ যদি অনলাইনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে চান, সেটারও সুযোগ আছে।
ছন্নছাড়া বিএনপি: সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাময়িক গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার নির্দেশনার অজুহাতে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতারা এখন নিম্ন সারির নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। ফলে, নেতাদের নির্দেশনা না পাওয়ায় দলটির বেশিরভাগ কর্মী-সমর্থকরা এখন দিশাহারা। ঢাকায় বিএনপির বা অঙ্গসংগঠনের কোনো কোনো নেতা হাতেগোনা কয়েকজনকে নিয়ে ঝটিকা মিছিল করছেন।
দেশের বেশিরভাগ জেলা ও মহানগরে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। তবে, দু’দিনের অবরোধের প্রথম দিন গতকাল রোববার বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও গাজীপুরের কিছু এলাকায় জোরালোভাবে মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। আর খুলনা ও বরিশাল ও রাজশাহী মহানগর এবং বিভাগের বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হচ্ছেই না। ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে।
বিএনপি নেতারা বলছেন পুলিশ তাদের প্রতি নির্মমতা শুরু করেছে। তাই তারা কিছুটা কৌশলে মাঠে রয়েছেন। হাইকমান্ডের নির্দেশনায় কর্মসূচি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। এছাড়া মানুষ তাদের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি মন থেকে গ্রহণ করেছেন।
জানা গেছে, অনেকটাই অপ্রস্তুত অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে বিএনপি। ওইদিনের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সফল করার পর ধাপে ধাপে শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দলটির। কিন্তু এখন তার বাস্তবচিত্র উল্টো। গত ২৮ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সংঘর্ষে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে শুরু হয় একেরপর এক মামলা।
দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পন্ড হওয়ার পর বিএনপি হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে রয়েছে। মহাসমাবেশ পন্ড হওয়ার পরদিন অর্থাৎ গত ২৯ অক্টোবর দলটির পক্ষ থেকে হরতালের ডাক দেয়া হয়। প্রথমেই গ্রেপ্তার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর থেকে বিএনপির হাই কমান্ডের একের পর এক নেতা গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ পুরো দেশকে কারাগার বানিয়ে ফেলেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে রিজভী বলেন, শেখ হাসিনা সমগ্র দেশটাকে এখন বৃহৎ কারাগার বানিয়ে ফেলেছেন। একদিকে সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আহব্বান জানাচ্ছে, আর অন্যদিকে সিনিয়র নেতাসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের ক্র্যাকডাউন শুরু হয়েছে। যা সর্বকালীন রাজনীতির বাজে ইতিহাসের সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য