-->
শিরোনাম

নির্বাচন ঠেকাতে এবার প্রকাশ্যে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম
নির্বাচন ঠেকাতে এবার প্রকাশ্যে বিএনপি

এম সাইফুল ইসলাম: ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে সংঘর্ষের দীর্ঘ একমাস পর এবার প্রকাশ্য কর্মসূচিতে নেমেছে বিএনপি। দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা রাজধানীতে একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নেন। হাইকমান্ডের নির্দেশেই দলটির নেতারা মাঠে নামতে শুরু করেছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সংলাপে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের কর্মসূচিতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অংশ নিতে দেখা গেছে।

 

ঢিলেঢালা অপবাদ ঘোচাতে টানা একমাসের কর্মসূচির চেয়ে আজকের অবরোধ ও আগামীকালের হরতাল শক্তভাবে পালনেও দলটির হাইকমান্ড বেশ সিরিয়াস বলে জানা গেছে। জামায়াতসহ সমমনাদেরকে শক্তভাবে কর্মসূচি পালনেরও তাগিদ বিএনপির। নির্বাচন ঠেকাতে আগামী ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দল ও সমমনাদেরকে মাঠে রাখার টার্গেট নিয়েই এগোচ্ছে বিএনপি।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন, সংঘর্ষের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অনেকে গা-ঢাকা দিলেও এখন সবাই মাঠে নামছেন। মোক্ষম সময়ে তারা আরও শক্তভাবে কর্মসূচি পালন করে ঢিলেঢালা কর্মসূচি পালনে দায় এড়াতে চান। কর্মসূচি পালনে পুলিশি হয়রানির বিস্তর অভিযোগ তাদের।

 

জানা গেছে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সংঘর্ষের পর অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়ে বিএনপি। শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করার পর ‘শর্টটার্ম’ শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল দলটির সেটি সম্ভব হয়নি। মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে একেরপর এক মামলা হয়। গ্রেপ্তার হন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে প্রথম সারির বেশিরভাগ নেতা।

 

সারা দেশে ১৬ হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দাবি দলটির। দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পন্ড হওয়ার পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দলটি গত এক মাসে ৭ম দফা হরতাল অবরোধ পালন করেছে বিএনপি। চলমান অবস্থায় দল বা অঙ্গসংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছিল সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার।

 

তাই বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের বেশিরভাগ নেতা তাদের কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়েছে অনেকটাই ঢিলেঢালা। বিশেষ করে রাজধানীতে কর্মসূচি পালনে ঝটিকা মিছিল ছিল বিএনপির যেন ভরসা। অবশ্য দলটির সমমনা কয়েকটি ছোট দল বো জোট প্রেসক্লাব-পল্টন এলাকায় নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে আসছে। বিএনপি নেতারা বলছেন দলের কৌশল ছিল নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত নেতাদের গ্রেপ্তার এড়ানোর। তফসিল ঘোষণার পর দলটির এখন টার্গেট দীর্ঘসময় আন্দোলনের। তারা ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত কমপক্ষে দুই বা তিনটি ধাপে আন্দোলনে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকা।

 

বিএনপির সমমনা একটি দলের নেতা ভোরের আকাশকে বলেছেন, তফসিলের আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনাল্ড লু সংলাপের আহব্বান জানিয়ে বড় তিন দলকে যে চিঠি দিয়েছেন সেটি মার্কিনসহ পশ্চিমাদের স্পষ্ট বার্তা যে, তারা বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। সরকারের ওপর পশ্চিমাদের কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার সব কৌশল আছে বিএনপির। আর দেশের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টির জন্যে তারা কর্মসূচি লম্বা করতে চান। দেশে সবকিছুর যে স্বাভাবিকতা আছে সেটি ব্যাহত করে সরকারকে চাপে ফেলতেই তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে বলেও মনে করছেন তিনি।

 

এবার দীর্ঘ একমাস পর গ্রেপ্তার এড়িয়ে গা-ঢাকা দেয়া নেতারা মাঠে নামতে শুরু করেছেন। দলটির একাধিক সূত্র চলছে বিএনপির হাইকমান্ড বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছে। নানা চাপ উপেক্ষা করে তফসিলও ঘোষিত হয়েছে। সরকার নির্বাচনের পথে। তাই নির্বাচন ঠেকাতে মাঠের আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছেন না তারা। চলমান আন্দোলনে বেশ লম্বা সময়ে তাদেরকে মাঠে থাকতে হতে পারে বলে নির্দেশনা রয়েছে তাদের। অনেকেই বলছেন নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মসূচি চলমান থাকবে। যেকোনো সময় তাদের জন্যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন আশাবাদীও বিএনপির অনেকে।

 

কর্মসূচি গ্রহণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জেলের বাইরে থাকা নেতারা দলটির কেন্দ্রীয়, জেলা-উপজেলা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নেতাদের পরামর্শ নিচ্ছেন। তাদেরকে শক্তভাবে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। কর্মসূচি গ্রহণ ও তা জোরালোভাবে বাস্তবায়নে বিএনপির হাইকমান্ড সমমনাদের পরাশর্ম গ্রহণ করছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ সমমনাদের আলোচনায় উঠে এসেছে একসঙ্গে অর্থাৎ একছাতার তলে এসে আন্দোলনের তাগিদ। বিষয়টি নিয়ে বেশিরভাগ দল এখন একমতে পৌঁছেছে।

 

বিএনপি নেতারা যে মাঠে নামছেন তার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে গতকাল মঙ্গলবার দলটির দুই নেতার প্রকাশ্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসমলাম খান ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে জাতীয় সংলাপে অংশ নেন। এছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কারাবন্দি বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বজনদের মানববন্ধনে অংশ নেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান। দলটির নেতারা এখন থেকে কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে মাঠে নামবেন বলে বিএনপির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

 

সরকারের পদত্যাগ, ঘোষিত তফশিল বাতিল একং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবিতে আজ বুধবারের অবরোধ ও কাল বৃহস্পতিবার হরতালে সমমনা জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সমমনা জোট, এলডিপি ও গণঅধিকার পরিষদসহ সঙ্গীদের সর্বোচ্চভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। পাশাপাশি চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে নিজস্ব কায়দায় হলেও কর্মসূচি পালনে কাজ করছেন বিএনপির কয়েকজন নেতা।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, কর্মসূচি ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হয়েছে এটি আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ স্বতঃস্ফর্তভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আর পুলিশ কিভাবে গ্রেপ্তার আর হয়রাণি করছে সেটি তো দেশের মানুষ জানেন। এর মধ্যেই কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা মাঠে ছিলেন। এখন থেকে সব নেতাকে মাঠে দেখা যাবে বলেও জানান তিনি।

 

এদিকে, দলটির একাধিক মধ্যম সারির নেতা বলছেন এখন তারা সিরিয়ালটি কর্মসূচি পালন করতে চান। ঢিলেঢালা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে এই তমকা তারা ঘোচাতে চান।

 

বিএনপির কারাবন্দিরে স্বজনদের মানববন্ধন: মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিবাদী মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন শেষে তারা প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দিতে গেলে তাদের প্রেসক্লাবের সামনে আটকে দেয় পুলিশ। পরে বিএনপির একটি আইনজীবী প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি পৌঁছে দেন প্রধান বিচার কাছে।

 

সেখানে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সহ-তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক কাদের গনি চৌধুরী, লেখক-সাহিত্যিক ও কবি আব্দুল হাই সিকদার, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের সভাপতি ড. লুৎফর রহমান, ঢাবির অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আফজাল আহমদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, সদস্য সচিব রাশেদ খানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীরা।

 

সংলাপে তফসিল বাতিল চেয়ে ইসলামী আন্দোলনের ৩ প্রস্তাব: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল বাতিল চেয়ে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মঙ্গলবার রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘জাতীয় সংলাপ’ অনুষ্ঠানে ৩টি লিখিত প্রস্তাব তুলে ধরেন দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। অনুষ্ঠানে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।

 

‘সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে’ দেয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে প্রথমটি হলো, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত একতরফা তফসিল বাতিল করে গ্রেপ্তার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিতীয়টি হলো, বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নির্বাচন। আর তৃতীয় প্রস্তাব রয়েছে, কার্যকরী সংসদ, রাজনৈতিক সংহতি এবং শতভাগ জনমতের প্রতিফলনের জন্য সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা।

 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সভাপতিত্বে জাতীয় সংলাপে সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন নজরুল ইসলাম, এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গোলাম মাওলা রনি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের যুগ্ম-আহব্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান, বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহ-সভাপতি রাশেদ পলাশ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, দলের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই, মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার ও নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ।

 

সংলাপে বক্তব্যে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শক্তভাবে মাঠে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন অংশকারী দলের নেতারা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version