-->
শিরোনাম

সর্বশক্তি প্রযোগ করবে জামায়াত

এম সাইফুল ইসলাম
সর্বশক্তি প্রযোগ করবে জামায়াত

এম সাইফুল ইসলাম: আন্দোলন করে সফলতার পর নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন দেয়াসহ বিএনপির কাছ থেকে কয়েকটি শর্ত পূরণ হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে জামায়াত ইসলামী। দল দুটির লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো। তবে লক্ষ্য এক হলেও একমঞ্চে মাঠের আন্দোলনে নেই জামায়াত। এতদিন জামায়াত যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালন করলেও এখন বিএনপি চাইছে একসঙ্গে মাঠে বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করতে। যার লক্ষ্য হচ্ছে ভোট প্রতিহত করা। কিন্তু বিএনপির এই চাওয়াকে যেমন দলটির সঙ্গে যুগপথের আন্দোলননে থাকা বাম দলগুলো সহ্য করতে পারছে না। অপরদিনে জামায়াতও আন্দোলনে সফল হলে পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব বিএনপির সঙ্গে এখনই করতে চাইছে।

 

জামায়াত নেতারা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছেন তারা। রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি যেভাবে মাঠে আছে তারও সেভাবে আছে। সবাই জোরেসোরে মাঠে নামলেও তারাও গতি বাড়াবেন এটি স্বাভাবিক। তবে, আন্দোলনে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের আগে হিসেব নিকেশ থাকবে এটিই স্বাভাবিক। আর বিএনপি নেতারা জামায়াতের ব্যাপারে কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন।

 

জানা গেছে- ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সংঘর্ষের পর অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পড়ে বিএনপি। শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করার পর ‘শর্টটার্ম’ শক্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল দলটির সেটি সম্ভব হয়নি। মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। পুলিশ কনস্টেবল নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীদের নামে একেরপর এক মামলা হয়। গ্রেপ্তার হন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে প্রথম সারির বেশিরভাগ নেতা। সারা দেশে প্রায় ১৮ হাজারের বেশি বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দাবি দলটির। দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হলেও সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দলটি গত এক মাসে ১০ দফা হরতাল-অবরোধ পালন করেছে বিএনপি। চলমান অবস্থায় দল বা অঙ্গসংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছিল সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার। তাই বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের বেশিরভাগ নেতা তাদের কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বেশিরভাগ স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়েছে অনেকটাই ঢিলেঢালা। বিশেষ করে রাজধানীতে কর্মসূচি পালনে ঝটিকা মিছিল ছিল বিএনপির যেন ভরসা। অবশ্য দলটির সমমনা কয়েকটি ছোট দল বো জোট প্রেসক্লাব-পল্টন এলাকায় নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে আসছে।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন- দলের কৌশল ছিল নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত নেতাদের গ্রেপ্তার এড়ানোর। তফশিল ঘোষণার পর দলটির এখন টার্গেট দীর্ঘসময় আন্দোলনের। ঘোষিত তফসিলে মনোনয়নপত্র জামা দেয়ার শেষ দিন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তারা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। কারণ অনেক নেতাকে ভোটে নিতে সরকারের তৎপরতা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে দলটির। এখন ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত কমপক্ষে দুই বা তিনটি ধাপে আন্দোলনে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টায় দলটির নেতারা।

 

বিএনপির সমমনা একটি দলের নেতা ভোরের আকাশকে বলেছেন, তফসিলের আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনাল্ড লু সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বড় তিন দলকে যে চিঠি দিয়েছেন সেটি মার্কিনসহ পশ্চিমাদের স্পষ্ট বার্তা যে, তারা বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। সরকারের ওপর পশ্চিমাদের কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার সব কৌশল আছে বিএনপির। আর দেশের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টির জন্য তারা কর্মসূচি লম্বা করতে চান। দেশে সবকিছুর যে স্বাভাবিকতা আছে সেটি ব্যাহত করে সরকারকে চাপে ফেলতেই তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হয়েছে বলেও মনে করছেন তিনি।

 

দীর্ঘদিন একমাস পর গ্রেপ্তার এড়িয়ে গা-ঢাকা দেয়া নেতারা মাঠে নামতে শুরু করেছেন। দলটির একাধিক সূত্র চলছেÑ বিএনপির হাইকমান্ড বিভিন্ন ইউনিটের নেতাদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছে। নানা চাপ উপেক্ষা করে তফসিলও ঘোষিত হয়েছে। সরকার নির্বাচনের পথে। তাই নির্বাচন ঠেকাতে মাঠের আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছেন না তারা। চলমান আন্দোলনে বেশ লম্বা সময়ে তাদেরকে মাঠে থাকতে হতে পারে বলে নির্দেশনা রয়েছে তাদের। অনেকেই বলছেন নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কর্মসূচি চলমান থাকবে। আন্তর্জাতিক চাপ এবং আন্দোলনে যেকোনো সময় তাদের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশাবাদী বিএনপির অনেকে।

 

কর্মসূচি গ্রহণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জেলের বাইরে থাকা নেতারা দলটির কেন্দ্রীয়, জেলা-উপজেলা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নেতাদের পরামর্শ নিচ্ছেন। তাদেরকে শক্তভাবে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। কর্মসূচি গ্রহণ ও তা জোরালোভাবে বাস্তবায়নে বিএনপির হাইকমান্ড সমমনাদের পরাশর্ম গ্রহণ করছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ সমমনাদের আলোচনায় উঠে এসেছে একসঙ্গে অর্থাৎ একছাতার তলে এসে আন্দোলনের তাগিদ। বিষয়টি নিয়ে বেশিরভাগ দল এখন একমতে পৌঁছেছে।

 

এছাড়া চলমান এই আন্দোলন সরকারকে চাপে ফেলতে যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করছেন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরা। তাই আন্দোলনেকীভাবে গতি বাড়ানো যায় সেটি নিয়েই এখন বিএনপির প্রধান ভাবনা। সেই ভাবনা থেকে দলটি মাঠে কঠোর আন্দোলনের কথা ভাবছে। যে আন্দোলনে শক্তি জোগাবে জামায়াত। সেই জায়গা থেকে জামায়াতকে পাশে পেতে তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। ইতোমধ্যে এই বিষয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

 

বিষয়টি নিয়ে জামায়াত কী ভাবছে তা জানতে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জামায়াত নেতারা মনে করছেন, বিএনপি যদি সত্যিকারে মাঠে আন্দোলন করতে চায় তবে অবশ্যই জামায়াতকে কাজে লাগবে। সরকার হঠানোর ইস্যুতে বিএনপির চাওয়ার সঙ্গে তাদের চাওয়ার মিল আছে। তবে, সর্বশক্তি দিয়ে জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার আগে বিএনপির কাছ থেকে কয়েকটি প্রতিশ্রুতি চায়। সেটি হচ্ছে, আন্দোলনে সফল হলে জামায়াত কয়টি আসন পাবে সেটি নির্ধারণ আগেই করতে হবে। এছাড়া আন্দোলনের মাঝপথ থেকে সরে না দাঁড়ানো। ২০১৩/১৪ সালে কঠিন সময়ের উদাহরণ টেনে জামায়াত নেতারা বলছেন, মাঠে আমরা পুলিশি মার ও মামলা খাব আর বিএনপি ঘরে বসে থাকবে এবার আর সেটি করতে চান না তারা। এছাড়া দলের ও সমমনা যুগপথের আন্দোলনে বামদের আধিপত্য কমানোর কমিটমেন্ট চায় জামায়াত। তারা মনে করছেন, এই আন্দোলনে সব দলকে কাজে লাগলেও বামদের সাংগঠনিক শক্তি একেবারে কম। তাই তাদেরকে বেশি প্রধান্য দেয়ার দরকার নেই।

 

জানা গেছে, নানা মান অভিমান থাকলেও গত দুই সপ্তাহের বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারা বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। বিএনপি নেতারা জামায়াতের বেশিরভাগ চাওয়ার সঙ্গে একমত হয়েছে বলেও জানা গেছে।

 

তবে, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি বামদল জামায়াততে এক মঞ্চে এনে আন্দোলন করার বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। দলটিকে এক মঞ্চে আনলে সমমনাদের অনেকে বিএনপির সঙ্গহ ছাড়তে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি বামদলগুলোকে যুগপথেই রেখেই ম্যানেজের চেষ্টা চালাচ্ছে।

 

রাজধানীর রমনা থানা জামায়াতের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, অতীতে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে রায় দেয়াসহ একটা কঠিন সময়ে বিএনপিকে আমরা পাশে পায়নি। ন্যূনতম কোনো রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ দেখায়নি বিএনপি নেতারা। তারা এখন সেটি উপলব্ধি করে এখন এগিয়ে আসছে। অভিমান থাকলেও বিএনপি এগিয়ে আসলে জামায়াতের দিক দিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে, অবশ্যই জামায়াতের সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে বিএনপির কমিটমেন্টে আসতে হবে।

 

বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলা জামায়াতের কর্ম পরিষদ সদস্য ও শিক্ষা, সহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ফজলুল হক কে বলেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে মাঠে আছে জামায়াত। আগামীতেও মাঠে থাকবে। বিএনপি যদি আরও শক্তভাবে মাঠে নামে জামায়াতও মাঠে নামবে জোরালোভাবে।

 

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশ কে বলেন, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে জামায়াত সমসময় অগ্রসর ছিল। কারণ, সবকিছুর মূলে হচ্ছে গণতন্ত্র। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না থাকলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না। সেটি এখন বাংলাদেশে বিরাজমান। তিনি বলেন, দলের সিনিয়র নেতারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেন। তাই বিএনপিসহ যাদের সঙ্গে আমাদের নেতাদের বৈঠক হয় সেখানে অবশ্যই চাওয়া পাওয়া আলোচনা হতেই পারে।

 

এদিকে, জামায়াতে এক কর্মপরিষদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের আকাশকে বলেন, নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন দেয়া ছাড়াও মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনে কয়েকটি কমিটমেন্ট বিএনপির কাছ থেকে পাওয়া গেলে তারা শক্তভাবে মাঠে নামবেন। বিএনপির সঙ্গে বৈঠক বা আন্দোলনের বিষয়ে তিনি কৌশলী উত্তর দিয়েছেন।

 

এদিকে, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, যারা মাঠে আন্দোলনে করছে তারাই গণতান্ত্রিক শক্তি। আন্দোলনে জোরালো করতে নানা কর্মকান্ড চালাচ্ছেন নেতারা। কৌশলে জামায়াতের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version