দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল ও সংঘাত বন্ধ হয়নি। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে বহিষ্কার, নিজ দলের নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর ভাঙচুর, মারধর, লুটপাট এমনকি কিছু জায়গায় প্রশাসন দিয়ে হয়রানি করার ঘটনাও ঘটছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।
১৫টি জেলার ২০জন নেতা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘গত সাত জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, যেন বিরোধী দল ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতার পালাবদলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে যেমন বিএনপি-জামায়াত নির্যাতন-হয়রানি করেছিল, এখন সেই ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। দলীয় সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার পরও কেন এমন ঘটনা ঘটছে, তার কোনো সদুত্তর পাচ্ছি না কোথাও।’
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মানিকসহ চার নেতাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন একই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নোয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য। গত ৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাদের অব্যাহতির ঘোষণা দেন তিনি। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করা হলেও অভিযোগ উঠেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে অপর এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার জেরেই তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যদি কাউকে বহিষ্কার করার প্রয়োজন হয়, তাহলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠাতে হবে। কাউকে বহিষ্কার করার এক্তিয়ার একমাত্র কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের। বিষয়টি চিঠি দিয়ে তৃণমূল নেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মোর্শেদ আলম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সেনবাগে একনায়কতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলাম। পরে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে আতাউর রহমান ভূইয়া মানিকের পক্ষে কাজ করি। এতে সংসদ সদস্য আমার ওপর ক্ষিপ্ত ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছেন।’ তিনি দাবি করেন, ‘ঐ ঘটনার জের ধরে সংগঠনের গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করছেন ঐ সংসদ সদস্য। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একজন উপজেলা সভাপতি কোনোভাবেই আমাকে বহিষ্কার করতে পারেন না। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে জানাব।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে সরাসরি কাজ করায় সাবেক সংসদ সদস্য এনামূল হকসহ রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকে দলীয় পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা। মাসখানেক আগে দেওয়া কারণ দর্শানো চিঠির (শোকজ) জবাব না দেওয়ায় তাদের দল থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে সম্প্রতি। অব্যাহতির সুপারিশ পাওয়া নেতারা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক, সহসভাপতি আবদুল মালেক মন্ডল, মতিউর রহমান, আফতাব উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক আল মামুন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান, মকবুল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম, ক্রীড়া সম্পাদক আশিকুর রহমান, নির্বাহী কমিটির সদস্য অনিল কুমার সরকার, আজাহারুল হক, লুৎফর রহমান, জাহানারা বেগম, মমতাজ আক্তার, জাহিদুর রহমান, আয়ূব আলী, আতাউর রহমান, জাফর আহম্মেদ, আবদুল জলিল, হাসান আলী, বাসুপাড়া ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারিক, ঝিকড়ার আবদুল মানিক প্রামাণিক, বড় বিহানালীর রেজাউল করিম ও দ্বীপপুরের আবদুস সাত্তার। তারা সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গত নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ।
অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন তিন বারের সংসদ সদস্য এনামুল হক। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে এনামুল হকের বিরোধ দীর্ঘদিনের।
সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনে নৌকার বিরোধিতা করায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের তিন নেতাকে দলের সব পদ ও কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাদের স্থায়ী বহিষ্কারের সুপারিশ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে পাঠানো হয়েছে। তিন নেতা হলেন—ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি তাজ মো. ইয়াছিন, পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর ওমর ফারুক জীবন এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সুলতানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মো. ওমর ফারুক। দলের সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিরোধিতা করায় গত ৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় তিন জনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন শতাধিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সব কটি সংঘাতের ঘটনাই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, যারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় সদস্য। নিজ দলের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
শনিবার বিশেষ বর্ধিত সভা : এমন অবস্থার মধ্যে সারা দেশে দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে গণভবনে তৃণমূল নেতাদের ডেকেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের তৃণমূল পর্যায়ে যেন আর কোনো সংঘাত না বাড়ে, সভা থেকে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন শেখ হাসিনা। কারণ গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে তৃণমূলে সংঘাত বেড়েছে। এ নিয়ে চিন্তিত দলটি। এছাড়া আসন্ন উপজেলা নির্বাচন এবং বিএনপি বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি নিলে তা মোকাবিলায় করণীয় নিয়েও দিকনির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
স্থানীয় নির্বাচন প্রসঙ্গ : আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা থাকছে না। এমনকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেও উপজেলা নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেবে না। ফলে উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় এমপিরা প্রভাব বিস্তার করতে চাইবেন। তারা তাদের পছন্দের লোককে সমর্থন দেবেন। এতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে কোন্দল আরো বাড়বে। তাই উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দলীয় এমপি ও স্বতন্ত্র এমপিরা যেন কোনো প্রভাব না খাটান, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক স্থানে এমপি লীগ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান লীগের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। তাই কোনো দলীয়-স্বতন্ত্র এমপিরা যেন কাউকে সরাসরি সমর্থন না দেন, এমন নির্দেশনা দিতে পারেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য