-->
শিরোনাম

আ.লীগে সন্দেহ-বিভেদ

সিরাজুল ইসলাম
আ.লীগে সন্দেহ-বিভেদ
রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন পীর ইয়ামেনী মার্কেটের সামনে একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফাইল ফটো
  • ত্যাগীরা কোণঠাসা
  • হাইব্রিডদের দৌরাত্ম্য
  • মাঠে ছিলেন না অনেকে
  • একে অপরকে দোষারোপ
  • কিছু কমিটি বিলুপ্ত
  • ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান

টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে দলে অনেক গ্রুপ-উপগ্রুপ তৈরি হয়েছে। ফলে নেতার পছন্দের লোক সুবিধা নিয়ে আসছেন। পেয়েছেন পদ-পদবী। কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এরই প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক সহিংসতায়। দলের অনেক নেতা মাঠে ছিলেন না। এ কারণে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ২৭টি ইউনিট কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। তর্কাতর্কি থেকে ধাক্কাধাক্কিও হয়েছে দুই নেতার মধ্যে। দলের মধ্যে যে বিভেদ ও দুর্বলতা রয়েছে; তা প্রকাশ্যে এসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কথাতেও। তারা নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া ছাত্রলীগের অনেক নেতা পদত্যাগ করাতেও তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এবং আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দলটির মধ্যে বিভেদ ও সন্দেহ প্রকাশ্যে চলে এসেছে।

তবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। এরই মধ্যে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। নিহতদের মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্য; আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী; পথচারী ও সরকারবিরোধী দলের লোকজন রয়েছেন। সরকারবিরোধীরা মূলত সরকারের পতন ঘটাতে সহিংসতা করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বিভিন্ন সরকারি দফতর; আওয়ামী লীগের কার্যালয়; মেট্রোরেল স্টেশন; এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে; বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অনেক স্থাপনা ভাংচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকদিনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ; নির্বাহী আদেশে ছুটি এবং কারফিউ জারি করে। কিন্তু বিরোধীদের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী মাঠে ছিলেন না। তারা অনেকে বাসায় ছিলেন; অনেকে ছিলেন আত্মগোপনে। এরই মধ্যে তাদের তালিকা শীর্ষ নেতাদের হাতে এসেছে। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠিনক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

অনেক বড় একটি বার্তা : এই বিক্ষোভের দুটো দিক রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। একটি হচ্ছে, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিকভাবে বড় একটি ধাক্কা খেয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল রাস্তায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় হতে না পারলেও যে কোনো দিক থেকে সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। অন্যদিকে এতো তীব্র একটি আন্দোলন সামাল দেবার মাধ্যমে সরকার আপাতত বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ কাজ নয়। তারা ধাক্কা খেয়েছে কোনো সন্দেহ নেই, ভয় পেয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে যে পরিমাণ প্রতিরোধ হয়েছে সেটাকে তারা হয়তো ধারণা করেনি। কিন্তু এটাকে ট্যাকেল (সামাল) করার মতো ক্ষমতা যে তার আছে সেটা সে মোটামুটি দেখাতে পারলো বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহা মির্জা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে সেজন্য আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনের জন্য ‘মেকানিজম ও সারভেইল্যান্স’ তাদের রয়েছে। এসব জায়গায় সরকার বছরের পর বছর ধরে আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে মনোনিবেশ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আবার সরকারের ভীত নাড়ানোর মতো ক্ষমতা যে মানুষজনের রয়েছে সেই বিশ্বাসও তৃণমূল পর্যায়ে তৈরি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, সরকারের জন্য এই আন্দোলন অনেক বড় একটি বার্তা দিয়েছে, যদি সরকার সেটা গ্রহণ করে। এটা শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। তিনি বলেন, যদিও যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে এই আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গেছে। ওরা ছাত্র হিসেবে যে পরিমাণ বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছে সেগুলো আর মেনে নিতে পারছিল না। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। জোর করে কখনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরি করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পাওয়ার জন্য অনেক ছাত্র কোনো নেতার আন্ডারে যায়, এর অর্থ এই নয় যে সে ওই রাজনৈতিক দলের সমর্থক হবে। এই সত্যটা সরকারকে বুঝতে হবে।

আওয়ামী লীগ যেভাবে দেখছে : এই বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিচলিত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দলটি গত ১৬ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকলেও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জোরালো রাজনৈতিক আন্দোলন সামাল দিয়েছে দলটি। এছাড়া ২০১৮ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনও সামলে নিয়েছিল দলটি। কিন্তু এই প্রথমবার বিক্ষোভ সামাল দিতে কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বিক্ষোভের মাত্রা এতোটা তীব্র হবে সেটি ধারণা করতে পারেনি ক্ষমতাসীনরা। এর কারণ হচ্ছে, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভার অবস্থায় ছিল।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এই বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে কি বোঝা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে? আসলে নড়বড়ে না। আসলে আমরা চিন্তাই করি নাই যে সন্ত্রাসের মাত্রাটা এই পর্যায়ে যাবে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে মনে করে এই আন্দোলন সহিংস হবার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা’।

এই আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের বার্তা নেবার কিছু আছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই আছে। আমাদের দুর্বল দিকগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। কর্মীদের সুসংগঠিত করতে হবে, সুশৃঙ্খল করতে হবে, কমান্ড মানতে হবে। কিছু কিছু তো আছেই। একদম সহজভাবে নিলে তো হবে না। চলার পথেই তো অভিজ্ঞতা... আপনি যদি চোখ বুজে থাকেন তাহলে তো আপনাকে আরো মূল্য দিতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করছেন যে, গত ১৬ বছরে ক্ষমতাসীনরা এতোটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নানা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন রাস্তায় সক্রিয় হয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়েছে কিংবা পুলিশের সাথে একত্র হয়ে তাদের ‘দমন’ করেছে। এবারও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস ও রাস্তায় ছাত্রলীগ বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি কোনো কাজে আসেনি। এই আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেবার কিছু আছে-

এই প্রশ্নের জবাবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, মানুষের জীবনে শেখার তো শেষ নেই। প্রতিটি পদে পদেই শেখা যায়। প্রতিটি পদে পদে জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হয়। এখানে শিখলাম, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই সন্ত্রাস চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অপচেষ্টা করে।

রাজনৈতিক পর্যেবক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি না থাকায় ক্ষমতাসীনরা গত ১৬ বছরে জনমতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যু যখন সামনে আসে তখন সেগুলোকে হয়তো উপেক্ষা করা নয়তো দাবিয়ে রাখার প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে।

এই সমালোচনাকে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টা হচ্ছে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ সবসময় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়। আমরা কিন্তু বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করেই যাচ্ছি। আমরা অ্যাড্রেস করি না এমন কোন জায়গা আপনি দেখাতে পারবেন না। সময়ে দিতে হয়, সময় দিলে বিষয়গুলোকে আমরা উপলব্ধিতে আনি। ..... আমাদের মাননীয় নেত্রীর কাছে যখনই সঠিক মেসেজটা পৌঁছায় তখনই উনি সেটা নিয়ে কাজ করেন।

এক প্রশ্নে মাহা মির্জা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে তারা পুরো মিডিয়া কন্ট্রোলে নিয়ে নিল। এর মাধ্যমে তারা তাদের ন্যারেটিভ সিস্টেমেটিকালি প্রচার করতেছে। এখন পুরো জিনিসটাই হয়ে গেল বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা। এই ন্যারেটিভটা তারা প্রতিষ্ঠিত করলো।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে ‘সরকার বিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে শুরু থেকেই। বিষয়টিকে তারা শুধুই কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে দেখেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন দিতে দ্বিধা করেনি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিএনপি। মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষের তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-অবরোধ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষোভ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতারা ফেল করেছেন, আপনারা ফেল করায় তারা এসব করতে সাহস পেয়েছে। ঘুরে দাঁড়ালেই আর এসব করতে পারত না। গত বৃহস্পতিবার রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় নেতাকর্মীদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা বসে ছিলেন কেন? আপনাদের নেতারা বসে ছিল কেন? পকেটে হাত দিয়ে যদি ঘরে থাকেন, তাহলে তারা ঘরে ঘরে ঢুকে মেরে ফেলবে। এর আগে তিনি আইজিপিকে নিয়ে কোটা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত তাজহাট থানা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন, রংপুর মহানগর ডিবি কার্যালয়, নবাবগঞ্জ ফাঁড়ি, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় পরিদর্শন করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমার কষ্ট হয়, আপনাদের পার্টি অফিস যখন ভাঙচুর করল, ‘তখন আপনারা নাই। অথচ পার্টি অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ভিডিওতে দেখা গেল মাত্র কয়েকজন এই রকম ঘটনা ঘটিয়েছে। আপনারা সেখানে অবস্থান নিয়ে সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের প্রতিহত করতে পারতেন।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version