-->

ঢাকা ঘিরে চতুর্মুখী কূটনৈতিক তৎপরতা

নেপথ্যে ভূরাজনীতি

নিখিল মানখিন
ঢাকা ঘিরে চতুর্মুখী কূটনৈতিক তৎপরতা

ভূরাজনীতির কঠিন বেড়াজালে বাংলাদেশ। বিশ্বমোড়লদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ প্রভাবশালী দেশগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে ইতিমধ্যে স্বাগত জানিয়েছে। একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তবে স্বাগত জানালেও প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে অন্তর্বতী সরকারের টানাপড়েন চলছে। এই সুযোগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মজবুত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এক রকম মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

অপরদিকে রাশিয়া কিছুটা নিস্ক্রিয় রয়েছে। তবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সম্প্রতি রাশিয়া সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। রাশিয়া সফরের শুরুতেই সেদেশে সফররত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দোভালের বৈঠক হয়। পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন দোভাল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বার্তা নিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দোভাল। তবে রাশিয়া সফরে থাকা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দোভালের বৈঠকটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনায় বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানা সমীকরণ করতে হচ্ছে। বিশ^ নেতৃত্বের মধ্যকার সম্পর্ক পর্যালোচনা করে এগোতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আর এতে করে বাংলাদেশ জটিল সমস্যায় পড়েছে। প্রথমেই ভাবতে হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। কারণ গত ১৬ বছর ভারত শেখ হাসিনাকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে গেছে। এমনকি শেখ হাসিনার পতনের পরও ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত যে এখনও শেখ হাসিনার পক্ষে শক্ত অবস্থানে আছে তা প্রমাণ হয়। এক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থানও অনেকটা একই মেরুতে রয়েছে। সরকার পতনের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে দায়ী করেছেন তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়। ভারত ও চীনের স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিনের। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক সব সময়ই বিপরীত মেরুর। প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আবার প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ওপর অন্য দেশের কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ ভারত। ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও জোরালো করার ক্ষেত্রে চতুর্মুখী চাপে রয়েছে বাংলাদেশ।

বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন ও জোরালো করার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথমত আমাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ আছে। সেটার সঙ্গে যে বৈদেশিক নীতির সম্পর্ক থাকবে না-এমন কোনো কথা নেই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা তো রিভিজিট করতে হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। সেটা একটা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখায় ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। তিনটা দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ব্যালেন্স করতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। সেই চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতেই হবে। আমরা কারও বিরুদ্ধে নই। এর বাইরেও যে চ্যালেঞ্জ নেই তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা দরকার।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও জানান, আমরা সব সময় সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করব। প্রথমত, অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক। ভারত, চীন আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে গুরুত্ব বেশি। তাদের সঙ্গে খুবই কার্যকর এবং পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। আমাদের অন্য পার্টনার যারা আছে, বিশেষ করে পশ্চিমে, যেখানে আমাদের রপ্তানির বড় অংশ যায়; তাদের সঙ্গেও আমাদের মসৃণ সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এর বাইরেও জাপান আছে, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছি। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। আমার টিমকে সঙ্গে নিয়ে এ জিনিসগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার দায়িত্ব। আমি সেই কাজ করে যাচ্ছি বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ সবসময়ই বলে এসেছে, সংঘাত কোনো সমাধানের পথ নয়। তাছাড়া আমরা বরাবরই কূটনীতিতে একটি বিষয় মেনে এসেছি, সেটি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত হিসেবেই দেখি। চীনের ক্ষেত্রেও তা-ই। এক্ষেত্রে অন্যের শত্রুকে আমরা কখনই আমাদের শত্রু হিসেবে নিইনি। এরই কারণে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বাংলাদেশের কাছে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর দাবি করেছিল, আমরা দিইনি। আবার চীন ও ভারতের মধ্যে যখন গালওয়ান উপত্যকায় সংঘাত শুরু হলো, তখনো আমরা কারো পক্ষ নিইনি। অন্যদিকে চীন-মিয়ানমারের মধ্যকার সুসম্পর্ক নিয়েও আমরা কখনো কোনো কথা বলিনি। সহজ কথা অন্যের বন্ধুত্ব বা শত্রুত্বের বিষয়গুলোর মধ্যে আমরা নেই। আমরা মূলত আমাদের উন্নয়ন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, অভ্যুত্থানে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল এবং গণমানুষের সমর্থন পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নতুন সরকারকে ঘিরে দেশের মানুষের গড়ে উঠেছে নানা প্রত্যাশা। আর এমন সময়ে আন্তর্জাতিক মহলেও এই সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। বিশ্বের শক্তিশালী বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারকে সবরকম সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই নতুন সময়ে আমাদের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়েও ভাববার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্বকূটনৈতিক তৎপরতায় সূক্ষ্ম ছক কষে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। আর সম্পর্ক স্থাপন ও জোরালো করার ক্ষেত্রে বিদেশিরাও বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখে দেখেশুনে এগোচ্ছে ভারত। বিগত সময়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় চীন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মানুষকেন্দ্রিক হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

গত ২ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা জানান, দ্বিপক্ষীয়ভাবে দিল্লির সঙ্গে টানাপোড়েন কমাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তৌহিদ হোসেন বলেন, আপনারা যদি মনে করেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে একটু টানাপোড়েন চলছে, সেটা দ্বিপক্ষীয়ভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। তবে আমরা একটা কথা মনে করি, সম্পর্ক মানুষকেন্দ্রিক হতে হবে। আসলে এমন হতে হবে, যেন মানুষও মনে করে যে, সম্পর্কটা ভালো।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে কিনা-মন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এ দুটির একটিকেও আমি ঠিক মানছি না। আমি মনে করি, কোনো এক পর্যায়ে কোনো এক কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে একটু টানাপোড়েন ছিল। স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক যদি উন্নীত হয়, আমাদের সবার খুশি হওয়া উচিত। আমরা তো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা করে তো কোনো ফায়দা নেই।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, তাদের সম্পর্ক ছিল দুই সরকারের মধ্যে। কিন্তু আমরা চাই, সুসম্পর্ক থাকুক জনসাধারণের পর্যায়ে। সেটার সঙ্গে সাধারণ মানুষ যুক্ত হোক। সেটা যে ছিল না, তা স্বীকার করা ভালো। মানুষের মাঝে ক্ষোভ ছিল, দ্বিপক্ষীয় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সেগুলো প্রশমন করা সম্ভব।

নেপথ্যে ভূরাজনীতি

বাংলাদেশ নিয়ে জোরালো কূটনীতির তৎপরতা দেখা গিয়েছিল গত জাতীয় নির্বাচনের আগে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় সেজন্য ভিসানীতি গ্রহণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের ধারায় থেকেছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাদের বাড়তি তৎপরতার বিরোধিতা করে চীন ও রাশিয়া জোরালো বক্তব্য দিয়েছিল। তারা এই তৎপরতাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং নব্য উপনিবেশবাদ হিসেবে আখ্যা দেয়। তবে প্রতিবেশী ভারতের কোনো তৎপরতা সেভাবে প্রকাশ্যে না এলেও অনেকের ধারণা, পর্দার আড়ালে ভারতও তৎপর ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পরও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে। এটি অনেকের কাছে দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ কেন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের বাঁক বদল ঘটেছিল ২০১৭ সালে। ওই বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে। অভিযোগ ছিল চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরই নামের মহাপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি কোয়াড (কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) ছিল মূলত তার পাল্টা পরিকল্পনা। চীনকে ঠেকানোর কৌশল। দুই জোট আমন্ত্রণ জানালেও বাংলাদেশ কোনোটাতেই যায়নি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূকৌশলগত দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নতুন করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ভারত মহাসাগরসংলগ্ন হওয়ায় বঙ্গোপসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ তার বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে প্রধান সংযোগ রুটে পরিণত করেছে। এ অবস্থায় বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে প্রভাব বজায় রাখা পরাশক্তিগুলোর কাছে প্রধান স্ট্র্যাটেজিতে রূপ নিয়েছে। গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে চীন। সুতরাং চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বাড়াতে হবে। এজন্য বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেন্টমার্টিনে ঘাঁটি থাকলে তা বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র এই সেন্টমার্টিনকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, জনসংখ্যা ও বাজারের আকারের সুবাদেও বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম স্থানে থাকা বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তার বাজার এবং কার্যকর শ্রমশক্তির জোগান দেয়। ফলে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ আন্তর্জাতিক পুঁজি বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এ গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের একেবারে মুখে বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে। একই সঙ্গে গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। জনসংখ্যার বিচারে এটি বড় দেশ। অনেকেই বাংলাদেশের এই বাজারে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন। বাংলাদেশের জলসীমায় প্রচুর সম্পদ আছে। এসব কারণে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তিনি আরও বলেন, বিদেশিদের বাড়তি তৎপরতার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও দায়ী। কারণ তারা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে। এ সুযোগটাই বিদেশিরা নিচ্ছে। এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে না। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, মিয়ানামার ইস্যু নিয়েও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ রয়েছে। চীন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষে, আর যুক্তরাষ্ট্র এর বিপক্ষে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস হয়, যার লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা। মিয়ানমারে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো সহায়তা না পেয়ে বাংলাদেশের ওপরই নির্ভর করছে। এ কারণেও বাংলাদেশ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনো অসুবিধা নাই, আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না। ২০০১ সালে বিএনপি গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন তারা দেশ বিক্রি করবে, নাকি সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়? আমি তো এটুকু বলতে পারি যে আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের কন্যা। আমার হাত থেকে এ দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় আসতে চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে তখন আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।’

শেখ হাসিনার অভিযোগ নাকচ কওে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করি। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নেওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের আলোচনায় আমরা কখনও যুক্ত হইনি।’ গত দশকের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছে বাংলাদেশ। সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ কখনও কোনো জোটের অংশ ছিল না। এ নিয়ে কোনো জটিল পরিস্থিতি কখনও দেখা দেয়নি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির ভোরের আকাশকে বলেন, ‘বাংলাদেশে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে উন্নয়ন সহযোগীরা বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হলেই ভূমিকা রাখে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। নিজেরা যতদিন সমস্যার সমাধান করতে না পারব, ততদিন এ ধরনের তৎপরতা চলতে থাকবে।’

ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মেরুকরণ

ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। একদিকে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ হিসেবে ভারতের ইউক্রেন ইস্যুতে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নামে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে জাতিসংঘে ভারত কখনও ভোট দান থেকে বিরত থেকেছে, কখনও নিন্দা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল পীড়াদায়ক। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ভারত রাশিয়া থেকে সুলভ মূল্যে তেল কিনে যাচ্ছে। আর এ লেনদেনের পুরোটাই হচ্ছে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রাশিয়ার রুবলে। ভারতের এই অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের প্রশ্ন, গত দুই দশক ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা কি তাহলে ভিত্তিহীন ছিল? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশটির বিশেষজ্ঞদের অনেকে দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভারতনির্ভরশীলতা কমিয়ে এ অঞ্চলের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর দিকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এদিকে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। চীন আর বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে ব্যবসায়িক মাত্রার পাশাপাশি রাজনৈতিক আর কৌশলগত অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছে গত কয়েক দশকে। একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চীন এখন রাশিয়ার বড় বন্ধু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ তাদের মিত্ররা যখন বাংলাদেশের গত নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছিল তখন চীন ও রাশিয়াও পাল্টা বিবৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর এমন বিপরীতমুখী অবস্থান বাংলাদেশের জন্য খুব একটা স্বস্তির ব্যাপারও নয়।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version