২০০৬ সালে জোট সরকারের শেষ সময়ে রাজধানীতে প্রকাশ্যে রুকন (সদস্য) সম্মেলন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এরপর গত ১৯ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে প্রকাশ্যে রুকন সম্মেলন করতে পারেনি দলটি। অবশেষে গতকাল রোববার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগরী উত্তর শাখার আয়োজনে রুকন সম্মেলন করেছে দলটি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে বাংলাদেশের মানবতা, গণতন্ত্রকে এবং জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল।
জামায়াত আমির বলেন, দীর্ঘ সাড়ে ১৭ বছর বহু ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ আবার আপন পথ ফিরে পেয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা কোনো অপরাধ করেননি। তারা জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে এসেছিল। তারা কাউকে আঘাত করেনি। সম্পূর্ণ গায়ের ওপর পড়ে তাদেরকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া লাশগুলোর ওপর পাষাণরা সেদিন দাঁড়িয়ে নাচানাচি করেছিল।
ডা. শফিকুর বলেন, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে সাজানো-পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিল তারা। এখন তাদের নাম সাহস করে কেউ নেয় না। আওয়ামী লীগ যারা করে তারাও সেই নাম নিতে চায় না। সুতরাং আমরা মজলুম জনগণ তাদের নাম নেব কেন?
ডা. শফিকুর বলেন, সাড়ে ১৫ বছর দাপটের সঙ্গে তারা দেশ শাসন করেছেন। ক্ষমতায় আসার মাত্র ২ মাসের মাথায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর গায়ে তারা আঘাত করে ৫৭ জন চৌকস ও দেশপ্রেমিক, প্রতিশ্রুতিশীল সেনা কর্মকর্তাকে বেদনাদায়কভাবে হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়ক-নায়িকারা তাদের অপরাধের পাওনা এখনো পায়নি। এ পাওনা তাদেরকে পেতে হবে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর তারা জামায়াতে ইসলামীর ওপর আঘাত দিতে শুরু করে। কারণ, তারা জানত জামায়াত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কারো কাছে বিলিয়ে দিতে রাজি হয়নি। বিক্রি করতে রাজি হয়নি এবং কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। তাই তারা তিলে তিলে গড়ে ওঠা জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুনিয়া থেকে বিদায় করেছে। বর্তমানে রাজপথের স্লোগান হলো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-জামায়াতের স্লোগানও ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’
তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সব খুনির বিচার করতে হবে। তবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে আগে সাম্প্রতিক গণহত্যায় জড়িতদের বিচার করতে হবে। তাদের বিচার এজন্য করতে হবে- শহীদদের তাজা রক্ত এখনো ভাসছে। আহতরা কাতরাচ্ছে। সাক্ষী মজুত। আলামত জীবন্ত ও স্পষ্ট। যত দ্রুত সম্ভব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে ওদেরকে সঠিক পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে।
জামায়াত আমির বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে বিভিন্ন দাবিতে সোচ্চার অরাজনৈতিক একটি সংগঠন হেফাজতের ওপর ক্র্যাকডাউন করা হয়েছিল। তা ছিল আরেকটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এটি ছিল আরেকটি গণহত্যা। কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তা আজও জাতি জানতে পারেনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দলটির নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, স্বৈরাচারী শাসন কখনো স্থায়ী হয় না। আওয়ামী লীগ টিকতে পারেনি। তারা দেশে, দেড় দশক ধরে অপশাসন-দুঃশাসন চালিয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতা থেকে লজ্জা জনকভাবে বিদায় নিয়েছে। ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে টিকতে পারেনি। তাই অর্জিত বিজয়কে অর্থবহ ও টেকসই করতে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি দেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান।
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, আমরা বীরের জাতি। তাই আমাদেরকে কেউ কখনো পরাভূত করতে পারেনি; আর কখনো পারবেও না। দেশে দীর্ঘ মেয়াদে ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরাচারী শাসন চলেছে। তারা অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের শেষ রক্ষা হয়নি।
ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঞ্চালনায় রুকন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ নাসিব হাসান রিয়ানের পিতা মো. গোলাম রাজ্জাক। তিনি বলেন, রিয়ান সব সময় শহীদ হওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। আল্লাহ তাকে সে মহান মর্যাদা দান করেন। আমি আমরা তার জন্য গর্বিত। তিনি শহীদ রিয়ানের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূর্ণতা দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। সম্মেলনে দারসুল কুরআন পেশ করেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আব্দুর রব, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ।
এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগরী উত্তরের নায়েবে আমির আব্দুর রহমান মূসা, ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, সহকারী সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান, নাজিম উদ্দীন মোল্লা, ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, মহানগরী উত্তর শিবির সভাপতি আনিসুর রহমান, পশ্চিমের সভাপতি সালাহ মাহমুদ প্রমুখ।
সম্মেলনে ২৮ অক্টোবর ও বেষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্য, আন্দোলনে আহতরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে ১০ হাজারের বেশি ডেলিগেট অংশ গ্রহণ করেন।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য