শোনা যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের পদধ্বনি। প্রতিদিন বিভিন্নভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে সব রাজনৈতিক দল। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে ‘দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন’ তথ্যটি বেরিয়ে এলেও রোডম্যাপ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। সরকারের মেয়াদ কতদিন তা সরকারই জানাবে বলে ইতোমধ্যে মন্তব্য করে রেখেছেন উপদেষ্টা প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবশেষ নির্বাচনের সময়ের বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ভিত্তিকে আরও মজবুত করে তুললো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বক্তব্য। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনও এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের মতামতেও দু’বছরের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে মন্থর সংস্কার কাজে ব্যাহত হতে পারে দ্রুত নির্বাচনের প্রত্যাশা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চতা রয়ে গেছে। সরকার গঠিত হওয়ার পর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের জনগণও অধির অপেক্ষায় কখন অনুষ্ঠিত হবে প্রতিক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রায় প্রতিদিনই রোডম্যাপের দাবি উত্থাপিত হয় বিএনপি নেতাদের মুখে। এই দাবি এক পর্যায়ে দেশবাসীর দাবিতে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব রাজানৈতিক দলই একই দাবিতে মুখ খুলতে শুরু করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। জাতির উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণেও তা ছিল না। বিভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে নির্বাচনি রোডম্যাপের বিষয়ে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ ও ‘জনগণ সিদ্ধান্ত দেবে’ এমন মন্তব্য করেছেন। সর্বশেষ ‘সরকারের মেয়াদ কতদিন তা সরকারই জানাবে’ বলে ইতোমধ্যে মন্তব্য করে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রথম দফা সংলাপেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়িত্ব এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তার ইঙ্গিত দিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমর্থনের অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যেও নির্বাচনি রোডম্যাপ দাবি থেকে সরে যায়নি রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনি রোডমাপ ও সংস্কার নিয়ে আলোচনায় উপদেষ্টা পরিষদ থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনি রোডম্যাপ ও সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে কথা বলার সময় সরকারকে যৌক্তিক সময় দেয়ার বিষয়টি যুক্ত রাখছেন। তাই ‘যৌক্তিক সময়’ শব্দ দুটি বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে।
এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আভাস দেয়ার পর এই প্রথম কোনো উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বললেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে আজকের সংবাদপত্র অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের পর নির্বাচন: সম্প্রতি প্রকাশিত বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) পরিচালিত এক জরিপে এই সরকারের মেয়াদ তিন বছর বা তার বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ৪৭ শতাংশ ভোটার। আর ৫৩ শতাংশ মনে করেন, এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বা তার কম হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ২ থেকে ৩ বছর চান সম্পাদকরা : দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘অন্তত দুই থেকে তিন বছর’ দায়িত্ব পালনের পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ২০ সম্পাদকের মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, গত শনিবার রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়ে বলেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার যেন ‘যৌক্তিক সময়’ পর্যন্ত থাকে। এই যৌক্তিক সময় আসলে কতটুকু? এ বিষয়ে ড. ইউনূস দেশের শীর্ষ সম্পাদকদের কাছে জানতে চেয়েছেন। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কী কী কাজ করতে হবে, ন্যূনতম কতটুকু কাজ করতে হবে- এসব প্রশ্ন রেখেছেন।’
সম্পাদকদের মতামত তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন রকম কথা এসেছে, সর্বনিম্ন যে সময়টা এসেছে- ২ বছর যাতে এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হয়। অনেকে আবার দুই থেকে তিন বছরের কথা বলেছেন।’
মন্থর সংস্কার কর্মসূচি: গত ১৯ সেপ্টেম্বর ৬ কমিশন প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের ৪ জন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারে যে ৬টি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারা ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবেন। কাজ শেষে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা করছে সরকার। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কারের ধারণা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। এ নিয়ে পরামর্শমূলক মতবিনিময় করা হবে; যেখানে সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তবে কী কী বিষয়ে সংস্কার আনা হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটির জন্যই কমিশন। তারা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার করা দরকার।
সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সংস্কার কাজ দীর্ঘ হতে পারে জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচনি ব্যবস্থার সব দিক নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করবো এবং তার ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করবো। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমাদের নয়। ৯০ দিন আমাদের সময় দেয়া হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সরকারের মেয়াদ কত হবে সেই আইনগত দিক আমি বলতে পারব না। তবে এই সরকার করা হয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে, রাষ্ট্র কাঠামো ঢেলে সাজানোর জন্য। আর রাষ্ট্র কাঠামো ঢেলে সাজানোর যে কর্মপরিধি তা কিন্তু স্বল্প মেয়াদে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক।
এদিকে, তিন মাস পর ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
গত ৫ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
মাহফুজ বলেন, তিন মাস পর ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে।
সংস্কার কমিশনগুলো তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেবে। সেগুলো নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের টাইমলাইন। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয় আছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনি রোডম্যাপের ব্যাপারে যে আলাপটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে ছয়টা কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। বাকিটা দুই-একদিনের মধ্যে ঘোষণা হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, কমিশন কাজ শুরু করার কথা ছিল ১ অক্টোবর থেকে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন হয়েছে দেরিতে। তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। ৩১ ডিসেম্বর ছয়টি কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে তাদের বসার কথা। এরপর নির্ভর করবে নির্বাচনের আগে কি কি সংস্কার কাজ তারা করতে চান এবং কোন কোন কাজ পরের নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেবেন। তিনি বলেন, এটি আপেক্ষিক বিষয়। ছয় মাসও হতে পারে আবার এক বছরও হতে পারে, কেউ মনে করতে পারে পাঁচ বছর লাগবে। আমার ব্যক্তিগত মত, কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করে আগামী বছর নির্বাচনের জন্য ব্যয় করবে। এখন নির্বাচন কমিশন নেই। নির্বাচন কমিশন আইন লাগবে। ইসি গঠনসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা বড় কাজ। এতে ৮-৯ মাস সময় লেগে যাবে। এসব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এখনই কমিশনের কাজ শুরু করা দরকার। পাশাপাশি একই সঙ্গে ইসির কাজও শুরু করা দরকার। এ জন্য সর্বোচ্চ আগামী বছরটা তাদের দেয়া যেতে পারে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য