-->

এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের গুঞ্জন

সিরাজুল ইসলাম
এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের গুঞ্জন

’৭৫ সালের পর থেকে সব চেয়ে ক্রান্তিকাল পার করছে আওয়ামী লীগ। টানা প্রায় ১৬ বছর দেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর থেকে দলটির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হচ্ছে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বুধবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় ছাত্ররা। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার আগেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে সরকারের পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের ওপর যে চাপ বাড়ছে; সেই কথাও ওঠে এসেছে তার কথায়। যদিও এর আগে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে কয়েক দফা ঝটিকা মিছিল করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বিবৃতি দিয়ে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে এই সরকারের এখতিয়ার এমনিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় বিএনপির কয়েকজন নেতা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তবে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন ‘কাল বিএনপিকে নিষিদ্ধ করলে করণীয় কী? আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাইরে রাখা হতে পারে- এমন জল্পনা-কল্পনাও রয়েছে। যদিও নির্বাচন কবে হবে তা এখনও নির্ধারণ হয়নি।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা একটি বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। এখনো এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়নি। একই প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অনেকে দাবি জানাচ্ছেন। তবে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমরা এ নিয়ে সংলাপ করব। তারা যদি চায়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এর আগে ‘সারডা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষে গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রিটে বিরোধিতা করে। গত ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের বেঞ্চ এ রিট খারিজ করে দেন। পরে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।’

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর ধরে হত্যা, গুম, ব্যাপক দুর্নীতি এবং ভোট কারচুপির মাধ্যমে একাধিকবার ক্ষমতায় আসার অভিযোগ ছিল। ছাত্র-জনতা হত্যার অভিযোগও রয়েছে দলটির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে। ফলে তারা রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার হারিয়েছে বলে অনেকে মনে করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সংলাপে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে একাধিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে মতামত দিলেও অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সেটি চাইছে না। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা চাই না দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ^াস করি। তবে আওয়ামী লীগের যারা নানা অপরাধ করেছেন, যারা গণহত্যা করেছেন, সেই ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে পারবেন না, জনগণ সেটা চায়। তাদের অপরাধের বিচার করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রে কোনো দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া যায় না। এ বিষয়ে আলোচিত রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামী এখনো পর্যন্ত দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেনি। তবে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার বিষয়েও মতামত দিয়েছেন। গত ১৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ শেষে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, যেসব দল গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে রাজনীতির সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তবে দলগুলো নিষিদ্ধ হবে কিনা- এটি বিচারের বিষয়। কিন্তু সে পর্যন্ত এই দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা উচিত। নিষিদ্ধ না হলেও নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে দূরে রাখা হতে পারে বলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হতে পারে বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে মানবতাবিরোধী কার্যক্রম ও গণহত্যার দায় প্রমাণিত হলে নির্দিষ্ট মেয়াদে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। এরই মধ্যে গণহত্যায় কোনো বাহিনী বা দলের সম্পৃক্ততায় গুম, খুন যৌন নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ও জড়িত রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর নিষিদ্ধ করাসহ আটটি সংশোধনীর প্রস্তাব করে আইন মন্ত্রণালয়।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিক্রিয়া : বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ ফেইসবুক লাইভে আসেন আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, যেহেতু শেখ হাসিনা সংবিধান অনুযায়ী, সশরীরে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে লিখিত পদত্যাগপত্র দেননি; তার মানে তিনি এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী আর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার অবৈধ। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার অবৈধ তাই, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ছাত্রলীগের ইতিহাস ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। তার দাবি, আওয়ামী লীগ কখনো কাউকে মারেনি, নিপীড়ন করেনি। ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনার ওপর হত্যার দায় চাপিয়ে জনগণকে ভুল বোঝানো হয়েছে।

প্রায় এগারো মিনিটের ফেসবুক লাইভে তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে এখন ফ্যাসিস্ট শাসন চালু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘কিশোর গ্যাং’ থেকে এসেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী নানক। তিনি বলেন, ‘হিজবুত তাহরীর’, ‘জামায়াত শিবিরসহ জঙ্গিরা’ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। অন্যদিকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করেছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের ওপর আঘাত করেছে। গত বুধবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবৈধ সরকার। এই সরকারের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। তাহলে দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ছাত্রলীগের মতো সংগঠনকে কীভাবে নিষিদ্ধ করল? অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ছাত্রলীগ নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ এ মাটির সংগঠন এবং আগামী দিনেও থাকবে।

তাদের এই বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের মিছিলের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন অনেকে। নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের একজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ এখন নেতৃত্ব শূন্য। সাহস করে কেউ মাঠে নামলে তৃণমূল ফের সক্রিয় হবে। অন্যদিকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘যাই করেন, আফটার ইফেক্ট কী হবে? কাজকে ঘৃণা করেন, জাতিকে নয়। জামায়াতের অনেক লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এবং অত্যাচারও করেছে। জামায়াত কিন্তু শেখ হাসিনার মতো একজন ‘ফ্যাসিস্টকে’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নাই। করেছে?’ যারা এখনও বিভিন্ন সংগঠনের নামে অত্যাচার করছে, মানুষ খুন করছে, লুট করছে তারা ‘আরামেই আছে’ মন্তব্য করে তিনি নেতা বলেন, ‘তাদের ধরে ধরে বিচার করেন। অর্থাৎ, অন্যায় করলে তার পরিণাম কী হয়, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।’ সরকার পতনের পর অনেক মানুষের সীমান্ত অতিক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে গয়েশ্বর বলেন, এতগুলো লোক দেশে-বিদেশে গেল, কার বদৌলতে? কে তাদেরকে পালাতে উৎসাহিত করেছে, সাহায্য করেছে এর জবাব কে দেবে? কাল বিএনপি নিষিদ্ধ হলে করণীয় কী সেই প্রশ্নও করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version