-->

মিত্রদের গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি!

এম. সাইফুল ইসলাম
মিত্রদের গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি!

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে দলের কঠিন সময়ের মিত্রদের গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় দলটি। এরই মধ্যে এমন ইঙ্গিত মিলেছে বিএনপি ও মিত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। দুঃসময়ে নিজেদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা পাঁচটি দলের শীর্ষ ছয় নেতাকে ইতোমধ্যে তাদের সাংগঠনিক কাজে সহযোগিতায় দলটি সংশ্লিষ্ট জেলা বিএনপির সভাপতি ও সধারণ সম্পাদককে চিঠিও দিয়েছে। যদিও দেশে এখনও নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এর আগেই মিত্রদের জন্য চিঠি দেয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম মুখরোচক আলোচনাও রয়েছে রাজনীতির মাঠে। অনেকেই বলছেন, এটি মিত্রদেরকে ধরে রাখতে বিএনপির কৌশল। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ প্রশ্নে মিত্রদের নিজেদের পক্ষে রাখতেই এমন কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিএনপি বলছে, আন্দোলনে থাকা মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতারা অনেকে নিজ এলাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজের প্রচার-প্রচারণা চালানোর সময় যেন বাঁধার সম্মুখীন না হন, সেজন্যই নিজ দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর বিএনপির মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বিএনপির ওই নির্দেশনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় আগে থেকেই জামায়াতে ইসলামীসহ ৪০টির বেশি দল বা সংগঠনকে নিয়ে শেখ হাসিসনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার হটাতে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছিল বিএনপি। এসব দলের বেশির ভাগই বিএনপির কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে। অনেক দল ভিন্নভাবে কর্মসূচি পালন করলেও মৌলিক দাবি বা কর্মসূচির ধরন ছিল একই। বিএনপি যখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল তখনও এসব মিত্র দলগুলো বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছিল। জামায়াত ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সাত দলের মধ্যে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, কমরেড সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, ড. রেজা কিবরিয়া গণঅধিকার পরিষদ, শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুর ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ছিল। শুরু দিকে গণতন্ত্র মঞ্চে থাকলেও পরে সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বের হয়ে গেলেও বিএনপির দাবির প্রতি দলটির শতভাগ সমর্থন ছিল। রাজপথে বিএনপির সঙ্গে ছিল কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বাধীন বিএলডিপি, ড. ফরিদুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ জাতীয় দল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জাগপা, ন্যাশনাল পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামিক পার্টি, এনডিপি, পিপলস লীগ, মাইনরিটি পার্টি ও জাগপা। এ ছাড়া ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও এবি পার্টি বিএনপির দাবি সমর্থন জানিয়ে রাজপথে ছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব দলের মধ্যে ফের জোট হয়, যা ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নামে পরিচিত পায়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির একতরফা ওই ভোটের পরও এসব দলের নেতারা রাজপথে ছিলেন যুগপৎভাবে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও বিএনপি জাতীয় ঐক্য বা দুঃসময়ে মিত্রদের গুরুত্ব দিচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতারা সব সময় জাতীয় ঐক্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরও বিএনপি নেতারা ছোট ছোট এসব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

দুঃসময়ের মিত্রদের বিএনপির গুরুত্ব দেওয়ার প্রমাণও মিলেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের ছয় নেতাকে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করতে গত ২২ অক্টোবর দলটির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১২ আসেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ঝিনাইদহ-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার জন্য দপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠির অনুলিপি সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতাদেরও দিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতারা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ওইসব আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে জোট নেতাদের জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহায়তা করতে বলা হয়েছে। এসব চিঠির বাইরে বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ বেশ কয়েকজনকে মৌখিকভাবে তাদের নির্বাচনী আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে, মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতার জন্য চিঠি দেওয়ার পর শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ প্রশ্নে টানাপোড়েন শুরু হওয়ায়।

শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি দল রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায়। আর বিএনপি সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টির বিষয়টিকে সামনে এনে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না। এমন প্রেক্ষাপটে এমন চিঠি দেয়ার মাধ্যমে মিত্রদের ধরে রাখার ‘কৌশল বা প্রলোভন’ হতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করছেন। আবার কারো কারো অভিমত, সত্যিকারেই বিএনপি মিত্রদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে চাইছে। মিত্রদের সহযোগিতায় এ চিঠি দেয়ায় বিএনপির তৃণমূলে অনেকে অসন্তোষ হলেও তারা কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পটুয়াখালী-৩ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী হাসান মামুন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির এই চিঠির সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নুরুল হক নুর এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে গেলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক তাকে বাধা দেয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এলাকায় গেলে একবার নুরুল হকের ওপর হামলাও হয়েছিল। আবার যাতে কেউ এ রকম ঘটনা না ঘটাতে পারে, সে লক্ষ্যেই মূলত বিএনপির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার নির্দেশ।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বিএনপির এই চিঠিকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা যেহেতু স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ছিলাম তাই এমন উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, দুঃসময়ের মিত্রদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকা ভালো।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের নেতারা যাতে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বলে দেওয়া হয়েছে। কারও সঙ্গে যাতে কারও মনোমালিন্য না হয়, সেই লক্ষ্যে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটি তো নির্বাচনের মনোনয়ন নয়। সুতরাং এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টির অবকাশ নেই।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version