-->

ওপরে টানাপোড়েন, ভেতরে সমঝোতা

এম. সাইফুল ইসলাম
ওপরে টানাপোড়েন, ভেতরে সমঝোতা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নানা বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সৃষ্ট টানাপোড়েন নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছে দল দুটি। সম্প্রতি দল দুটির নেতাদের কথায় যার প্রমাণও মিলেছে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে ফের স্বৈরাচারের মাথাচাড়া, ভারতীয় আধিপত্য সৃষ্টি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা থেকেই বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার এই উদ্যোগ।

দল দুটির নেতারা বলছেন, নিজেদের মধ্যে চাওয়া-পাওয়া বা অবস্থান নিয়ে কমবেশি মতবিরোধ থাকতেই পারে। আওয়ামী লীগের পতনের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর দল দুটির মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টির কথা স্বীকারও করেছেন তারা। তবে এখন দল দুটির উভয়ের চাওয়া জাতীয় ঐক্য। যে ঐক্যের ভিত্তিতে তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়েছেন সেই ঐক্য ধরে রাখতে না পারলে তার সুযোগ নিয়ে স্বৈরাচার আবারও দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারাই মাঠে ছিল তাদের নিয়ে আমরা ঐক্য চাইছি। জামায়াতের ইস্যুতেও আমাদের একই অবস্থান, যা আমি জামায়াতের অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছি।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে আগামীতেও বিএনপি জামায়াত এক থাকবে ইনশা-আল্লাহ। মাঠের কথাবার্তা যাই হোক না কেন, দুই দলের মৌলিক চাওয়া এক।

দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছে বিএনপি ও জামায়াত। মাঝে মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হলেও তাতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি দল দুটির সম্পর্ক বা জাতীয় কোনো ইস্যুতে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে। তার সর্বশেষ নজির জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দল দুটির পাশাপাশি থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই আন্দোলনের জেরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শুধুই শেখ হাসিনা নন, তার সরকারের সব মন্ত্রী, অনেক আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা পালিয়েছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও পালিয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে গেছেন, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে দল দুটিতে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় নিয়ে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট বিভাজন দেখা দেয়। জামায়াতের আমির বলেছিলেন, একটি কার্যকর সংস্কার করতে হলে সরকারকে সময় দিতে হবে। আর বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য ছিল, সংস্কারের নামে বেশি সময় নিলে তৃতীয় পক্ষ কেউ সুযোগ নিতে পারে। এই ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বেশিরভাগ সভা-সমাবেশে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনি রোডম্যাপ নেই দাবি করে বিএনপি তার সমালোচনা করেছিল। যদিও জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে মাইলফলক বলে অভিহিত করেছিল। এছাড়া জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল বিএনপি। যদিও জামায়াতের দাবি দলটির আমির সরাসরি আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দেননি, তার বক্তব্য অনেকে বুঝতে পারেননি।

সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ ইস্যুতে দলটি প্রকাশ্যে মতবিরোধে জড়িয়েছে। বিএনপি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা চায় না। দলটির বক্তব্য হচ্ছে, সর্বোচ্চ এই পদে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে ফের ১/১১-এর পরিস্থিতির নানা আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আর জামায়াত বলছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পতিত শেখ হাসিনার মতোই স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টের সহযোগী। কারণ রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পেয়েছেন ও তা গ্রহণ করেছেন মর্মে বললেও একটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তা অস্বীকার করেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি সুযোগ পেলে যেকোনো সময় বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন। তাই জামায়াত তার পদত্যাগ চেয়েছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিল। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিয়েও নিজেদের দল দুটির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বত্র যার প্রভাব পড়ে।

বিষয়টি নজরে আসার পর বিএনপি ও জামায়াত নেতারা তা নিরসনেও কাজ শুরু করেছেন। গত ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের প্রতিবাদে জামায়াত আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশে গত সপ্তাহে যোগ দিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জামায়াতের প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগমুক্ত দেশ গড়তে হবে। প্রয়োজনে বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশ গড়বো আমরা। একই অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেছেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য আরো জোরদার করতে হবে। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল যেন ফিরতে না পারে সে ব্যাপারে ঐক্য গড়তে হবে। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে মতের অমিল থাকতে পারে, তবে ফ্যাসিবাদমুক্ত থাকতে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ হঠাতে আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। ফ্যাসিবাদ মুক্ত থাকতে হলে আসলে নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখা যাবে না। তাহলে অন্য কেউ সুযোগ নিতে পারে। ঐক্য আসলেই দরকার।

যশোর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, সম্প্রতি কিছু বিষয় নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ২৮ অক্টোবরের আমাদের কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য শুনে এখন কর্মীরাও বুঝছেন দুই দলই ঐক্য চাইছে। আসলেই ফ্যাসিবাদ ঠেকাতে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

বিষয়টি নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, বিএনপি ও জামায়াতে অনৈক্য সৃষ্টি হলে ফ্যাসিবাদিরা সুযোগ নিতে পারে। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর জোর দিচ্ছি। তিনি বলেন, কিছুটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছিল, এটা অসত্য নয়। তবে সেই মনোমালিন্য এখন আর দেখছি না। দুই দলই চাইছে ঐক্য। তিনি আরও বলেন, ঐক্য না থাকলে এখানে আবারো ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্য নতুন করে বিস্তার লাভ করতে পারে।

জানা গেছে, বিএনপি সরকারের ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে জামায়াত। এই বিরোধের সুযোগ নেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপি জোট ছেড়ে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে। ফলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। পরে আওয়ামী লীগ ঠেকাতে ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট হয়। চারদলীয় জোট গঠনের মাধ্যমে দুই দল জোটবদ্ধ হয়ে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে। ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে দল দুটি। সেই থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কে উত্থান-পতন হলেও জোট ভাঙেনি।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে বিএনপি ও জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির প্রতীকে প্রার্থী হন। ২০২২ সালে দু'দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামে। প্রথম দিকে জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও মাঝে কিছু সময় নানা অভিযোগে জামায়াত সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে ফের ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে জামায়াত। গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার গণহত্যা চালায়। বিএনপি ও জামায়াতকে আন্দোলনের জন্য দায়ী করে ঢালাও মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ জুলাই জামায়াতের নাম উল্লেখ করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি। ওই আন্দোলনে দল দুটি সর্বোচ্চভাবে মাঠে ছিল।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version