আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টায় ধীর গতি দেখা দিয়েছে। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আলোচনা শুরু হলেও নানা বিষয়ে মতপার্থক্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চিন্ত-ভাবনায় ওই ধীর গতির বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তোড়জোড় দেখা গেলেও দিনকে দিন তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। দলগুলোর নেতারা পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতা বা বোঝাপড়ায় নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার গতি বাড়ানোয় তাদের নেতাকর্মীদের মাঝে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল তা ক্রমেই ফিঁকে হতে চলেছে। তাদের অনুসারীরাও নিজেদের ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তিকে পাশ কাটিয়ে জোটবদ্ধ দেখতে আগ্রহী হলেও ঐক্যের সুরে ভাটা পড়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতারা দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বেশির ভাগ ইসলামী দল এককাতারে আসার জন্য আগ্রহী। এজন্য নিজেদের আকিদাগত ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তি একপাশে রেখে একটু সময় লাগলেও মৌলিক জায়গায় তারা এককাতারে পৌঁছাতে পারবেন। তারা এক হতে পারলে দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলেও আশাবাদ তাদের।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে জামায়াত ইসলামী। এই আলোচনায় দলটির কাছে ইসলামী দলগুলোও বেশ গুরুত্ব পায়। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলনও ছিল। এছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমীর মতো আলেমদের সঙ্গেও জামায়াত নেতারা একাধিক বৈঠক করেন।
এসব বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ইসলামী দলগুলোর মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত রাখা এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তোলা। যার প্রভাব মাঠ পর্যায়েও পড়ে। দলগুলোর বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। তারা মনে করেছিলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসলামী দলগুলো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে এমন বক্তব্যও আসতে শুরু করে। কিন্তু সেই উদ্যোগে ভাটা দেখা যাচ্ছে।
ইসলামী দলগুলোর সেই ঐক্য প্রক্রিয়া এখন কোন পর্যায়ে সেটি জানতে ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর দৈনিক ভোরের আকাশ এর পক্ষ থেকে কথা যোগাযোগ করা হয়। তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের পর যে ঐক্য প্রক্রিয়া চলছিল সেটি এখনো চলমান। দলগুলোর নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তাও অব্যাহত রয়েছে। তবে, গতি কমেছে। কারণ হিসেবে বেশিরভাগ মাঠ পর্যায়ের কর্মী বলেছেন, দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে ‘আকিদাগত’ অমিলই ঐক্যে গতি মন্থর হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া জামায়াত ইসলামীকে অনেকে ‘মওদুদীবাদ’ মনে করাও নিজেদের মধ্যে ঐক্যে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি কীভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য হবে সেটি তাদের ভাবনায় রয়েছে। সব দলের প্রার্থী না হয়ে যেন একক প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হয় সেটি বিশদ আলোচনার বিষয়। এব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে সময়ের প্রয়োজনীয়তার কারণে ইসলামী দলগুলোর ঐক্যে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন। তবে বৃহত্তর স্বার্থে জোটবদ্ধ হতে সব দলের নেতাকর্মীর ইতিবাচক আগ্রহ রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতের ইসলামের শীর্ষ নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর বৃহৎ ঐক্যের ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে দিনদিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। দেশের মানুষ ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন মত ও পথের নেতৃবৃন্দকে এককাতারে দেখতে চাওয়ার তাদের যে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে বলে আমি মনে করছি। তিনি বলেন, ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রাখতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের কথা বলে আসছি আমরা। এটা আমরা আওয়ামী লীগ পতনের পর বলছি সেইরকম নয়। আর বিষয়টিতে ইসলামী দলগুলোর আগ্রহও বেড়েছে। জোট করতে গেলে কিছু মতপার্থক্য থাকে। কে কতটুকু ছাড় দিবে সেটার একটা বিষয় থাকে। সবমিলিয়ে তো একটা ঐক্য। তাই বিষয়টি তড়িঘড়ির বিষয় নয়। এটি সময় সাপেক্ষ। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলমান। এর লক্ষ্য হলো ইসলামী শক্তিগুলোকে এক জায়গায় আনা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষেরও একটা আগ্রহ আছে। কারণ তারা তো বিভিন্ন দলের ভূমিকা দেখছেন, অনেকটা হতাশ হয়েছেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া আছে, ইসলামী শক্তি এক কাতারে আসলে তারা ভালো থাকবেন। জামায়াত ইসলামী আকিদাগত সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো কোনো কওমি উলামায়ে কেরামের দলটির বিষয়ে আপত্তি থাকলেও আসলে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকা ভালো কথা নয়। আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। ধাপে ধাপে এগুচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। নির্বাচনের কাছাকাছি গেলে চূড়ান্ত অবস্থায় রূপ দেওয়া যাবে বলেও মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য