নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি সরব হলেও অনেকটাই নীরব জামায়াতে ইসলামী। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে নির্বাচনি সময়ক্ষণ ‘অস্পষ্ট’ দাবি করে সমালোচনা করছেন বিএনপি নেতারা। দলটির নেতারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপের দিকে এগোলেও তিনি সময়ক্ষণ নির্দিষ্ট করেননি। প্রধান উপদেষ্টা ২৫ অথবা ২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হবে বলে বক্তব্য দিলেও তার প্রেস সচিব বলেছেন ২৬ সালের জুনে নির্বাচন হবে। দুজনের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী বলে মনে করে বিএনপি। বিষয়টি দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভার আলোচনাও স্থান পেয়েছে। তবে, জামায়াতের নেতারা নির্বাচনের ব্যাপারে কৌশলী ভূমিকায় থেকে অনেকটাই নীরবতা পালন করছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে একটি নির্বাচন যেমন দরকার তেমনি রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেয়াটা জরুরি।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে যদি, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচনসম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, রোডম্যাপ খুব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝেও নির্বাচন হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা এটা আলোকপাত করেছেন। নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যেই। সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্বাচন কমিশন দেবে।
প্রধান উপদেষ্টার ওই বত্তব্যের পর ওইদিন থেকেই বিএনপি নেতারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তারা নির্বাচনি রোডম্যাপকে সাধুবাদ জানালেও নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়ক্ষণ ঘোষণা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য যুগযুগ ধরে অপক্ষো মেনে নেওয়া যায় না। বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। আর বিষয়ে জামায়াত নেতারা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের এ বিষয়ে বক্তব্যের পরও বিএনপি নেতারা সমালোচনা করেছেন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছি; সংস্কার হবে। তবে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে রাজি নই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ এসব কিছুর জন্য রাজনৈতিক সরকার দরকার। নির্বাচনের রোডম্যাপ দরকার। তিনি বলেন, সংস্কার নতুন কিছু না। এটা একটা প্যাকেট না যে, একটা প্যাকেটে করে এনে আমি সংস্কার হয়ে গেলাম। এটা সময়ের বিবর্তনে, সময়ের চাহিদায় সংস্কার প্রয়োজন হয়। আমরা আশা করছি, এই সরকার দ্রুততম সময়ে জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফেরত দেবে এটাই আমাদের কাম্য।
গত বুধবার মহাখালীতে একটি অনুষ্ঠানে দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য ৪ থেকে ৬ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এ সরকারের প্রধান ও প্রথম কাজ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন করা। আর সে জন্য কিছু আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও মাঠের সংস্কার দরকার। আমরা পর্যবেক্ষণ করে ও বিশ্লেষণ করে বের করেছি, এক্ষেত্রে সংস্কারে চার থেকে ছয় মাস বেশি সময় লাগার কথা নয়। গণতান্ত্রিক যাত্রা পথে আমরা যেন কোনো কৌশল প্রয়োগ না করার জন্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে আহ্বান রাখেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর বুধবার রাতে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আমরা হতাশ। ১৮ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেই সভায় গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপদেষ্টার ভাষণের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা নিয়েও আলোচনা হয়।
ড. ইউনূসের ভাষণে নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্য অস্পষ্ট বলে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, সভা মনে করে তার (ইউনূস) বক্তব্যে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলা হলেও নির্বাচনের রোড ম্যাপ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখা হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের প্রথম অংশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন, যা একেবারেই অস্পষ্ট। নির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ নেই। অথচ তার প্রেস সচিব বলেন যে, ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; যা পরস্পরবিরোধী। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করে বিএনপি।
এদিকে, বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে প্রায় প্রতিদিন বক্তব্য রাখলেও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের এ বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। দলটি এ বিষয়ে যেন কৌশলগত নীরবতা পালন করছে। দলটির নেতারা তাদের সভা-সমাবেশে নির্বাচনের কথা বললেও একটি কার্যকর সংস্কারের সময় দেওয়ার কথাও বলছেন।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, আসলে দেশে একটি নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন রয়েছে একটি সত্য। তবে, দুই হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়েছে যে উদ্দেশে সেটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার। সেটিও প্রয়োজন। তাই বর্তমান সরকারের যৌক্তিক সময় দিতে হবে। একটি নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করা যাবে না।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য