বিএনপি-জামায়াতের কাঁদা ছোড়াছুড়ি

এম. সাইফুল ইসলাম
বিএনপি-জামায়াতের
কাঁদা ছোড়াছুড়ি

ফের বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিন ধরে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তব্য দিচ্ছেন। জামায়াতের কয়েকজন নেতাও বিএনপির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে দলটির তৃণমূলও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরপর দুইদিন জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছেন। গতকাল শুক্রবারও তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত ঐক্যের জায়গায় আমাদের ব্যর্থতা আছে। নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারণে ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগ সুযোগ পাচ্ছেও বলেও আগেরদিন তিনি মন্তব্য করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গতকাল বলেছেন, জাতীয় ঐক্যর বিকল্প নেই। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বরাবরই ‘জাতীয় ঐক্য’র কথা বলছেন। দল দুইটির তৃণমূলও ঐক্যে জোর দিয়েছে। ‘বিশেষ গোষ্ঠী’র সুযোগ নেওয়া ঠেকাতে বিএনপি ও জামায়াতের বোঝপড়া দরকার বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় চার মাস পর গত মঙ্গলবার জাতীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিল্পবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে বৈমষ্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমাবেশের ডাক দেয়। বাহাত্তরের সংবিধানকে বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান ঘোষণা করাই ছিল ওই সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ওই উদ্যোগ নেয়। যদিও ওই সমাবেশের আগেরদিন সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঘোষণা দেন সরকার ‘জুলাই বিল্পবের ঘোষণাপত্র’ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। তারপর ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামের সমাবেশ করলেও সেখানে ঘোষণাপত্র আর পাঠ করা হয়নি ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। তারপরও ওই ঘোষণাপত্র পাঠের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। গত রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াত ইসলামী নিয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জামায়াত কিন্তু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। এছাড়া দলটির প্রতি ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারীদের ছবক শুনতে জাতি রাজি নয়। এছাড়া ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ১ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল গিতে দিয়ে ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রশিবির কাউন্সিলের নামে নাটক করেছে। দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, শহীদ মিনারে ঘোষণাপত্র পাঠ করতে চেয়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরকে দিয়ে জামায়াত বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা গত কয়েকদিন জামায়াতের নানা নেতিবাচক বিষয়গুলোকে সামনে এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এদিকে, জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের ব্যাপাারে নিশ্চুপ থাকলে গত কয়েকদিন দলটির মাঠ পর্যায় থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বিশেষ করে বিএনপি নেতা রিজভীকে নিয়ে নানা মুখরোচক পোস্ট দিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে পরপর দুদিন জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য দেন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তায়ন নিচে পড়ে। ফলে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের চুরি, দুর্নীতি, লুটপাটগুলো নিচে পড়ে যাচ্ছে। এরা এক ধরনের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এ কথাগুলো আমাদের বারবার বলা দরকার। কারণ, এটা না বললে আওয়ামী লীগ যে দুর্বৃত্তায়ন করেছে, সেটা মানুষ ভুলে যাবে।

গতকাল দিনাজপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার ‘সুবর্ণ জয়ন্তী ও গুণীজন সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা বলেছেন, আমরা আবার একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। সেই স্বপ্নটি হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেনÑ একটি সুখী, সুন্দর, সমৃদ্ধ, প্রেমময় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। সেই বাংলাদেশকে নির্মাণ করার আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা ’৭১ সালে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, এরপর গণতান্ত্রিক যুদ্ধেও ছিলাম। আজকে সেই গণতান্ত্রিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ঐক্যের যে যুদ্ধ, সকলে মিলে একসঙ্গে দেশটাকে যে গঠন করব, নির্মাণ করব, একটা পথরেখা দেখাবো; আজকে এই বয়সে এসে আমার কাছে মনে হয়, এই জায়গায় আমাদের ব্যর্থতা আছে।

এদিকে, গতকাল নাটোরে কর্মী সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে সাম্যের। আমরা সত্যিকারের স্বাধীন দেশের নাগরিক হবো। সাম্যের বাংলাদেশ গঠনে জামায়াত ইসলামী মানুষের দোয়া, ভালোবাসা, পরামর্শ ও ইতিবাচক সমালোচনা চায়। তিনি বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি দেখতে চাই। এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। দেশকে একটা গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরাতে ঐক্যের বিকল্প নেই।

এদিকে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেযারম্যান তারেক রহমানও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে আসছেন।

দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জাতীয় ঐক্যের উপর জোর দিলেও কেন বারবার দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একসঙ্গে শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও জামায়াতে কেন অনৈক্য? কার স্বার্থে এমন অনৈক্য সে প্রশ্ন এখন দল দুটির সাধারণ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে। খোদ শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে এখনও স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। এই অবস্থায় বড় দল জামায়াত ও বিএনপির জাতীয় সব ইস্যুতে এক জায়গায় থাকতে হবে। অন্যথায় পতিত আওয়ামী লীগ সুযোগ নিতে পারে।

এদিকে, বিএনপি ও জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের নেতারাও বর্তমান পরিস্থতিতে দুই দলে অনৈক্য চান না। যেহেতু হাইকমাণ্ড এ বিষয়ে কথা বলছেন, তাই তারা প্রকাশ্যে বিষয়টিতে মন্তব্য করতে চান না।

এদিকে, গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকে নির্বাচনের সময় প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের দেয়া পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সংস্কার কাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। আর জামায়াতের নেতারা বলেছেন, শহীদদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। তাই একটি সংস্কারের পর নির্বাচন চায় দলটি। তাদের বক্তব্য ছিল শুধুমাত্র নির্বাচনের জন্যে হজারো মানুষ জীবন দেয়নি। পর কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতেও দল দুটিতে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, বাংলাদেশে নানা সমীকরণ চলছে। দেশি-বিদেশি নানা হিসেব নিকেশ রয়েছে এখানে। তাই বিএনপি ও জামায়াতের মতো বড় দুই দলের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হলে নানা আশঙ্কা রয়েই যায়। ‘বিশেষ গোষ্ঠী’র সুযোগ নেওয়া ঠেকাতে বড় দুই দলে বোঝপড়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য