-->
শিরোনাম

বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে ডিজিটাল আসক্তি

রাজন ভট্টাচার্য
বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে ডিজিটাল আসক্তি
ডিজিটাল আসক্তিতে ভুগছে কিশোর-তরুণরা

বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস তার সন্তানদের নিজের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। তিনি একবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের যে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’

টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। বিশ্বের প্রায় ২৭০ কোটির অধিক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এই আসক্তি থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। হাতে হাতে মোবাইল ফোন।  

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে- ফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া।

সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বেশি। ডিজিটাল আসক্তি যেন এখন ডিজিটাল আগ্রাসনের নাম। যাকে রুখতে না পারলে আমাদের আগামী প্রজন্ম আলোর দিশা হারাতে পারে। 

বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়াদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর। যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যারা সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার, ই-রিডার্স, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য প্রযুক্তির পেছনে থাকে তাদের অর্ধেকের বয়স ১৩-১৭ বছর হলেও, করোনাকালে এর ব্যবহার বেড়েছে দ্বিগুণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা শহর হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেসবুক ব্যবহারকারী নগরী।

এমন বাস্তবতায় পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুদের দ্রুত সামাজিক ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অভিভাবকদের ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিশুদের নির্ধারিত সময় পর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। ভালো বই পড়া ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে শিশুদের যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা না হলে ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধী প্রজন্ম তৈরি হবে। সমাজে বাড়বে নানা রকম অপরাধ। সেইসঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে ডিজিটাল আসক্তির সুফল ও কুফল যুক্ত করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ১১ কোটি ২৭ লাখ ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। যার মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে মোবাইল ও ট্যাবলেট গেমিংয়ে প্রতি বছর ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজি গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ! দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত। করোনাকালে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সি অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না।

গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এতে শিশুদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।

বিশ্বের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক ইন্ডাস্ট্রি হলো পর্নোগ্রাফি। ইন্টারনেটে ইনডেক্স করা প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন পর্নোগ্রাফিক সাইট আছে, যেখানে সহজেই যে কেউ যখন-তখন প্রবেশ করতে পারে। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কারণে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ৫-৭ বছরের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুর ১২ শতাংশ এবং ৮-১৭ বছরের ১৬ শতাংশ শিশুর সামনে ইনডেক্স করা এ ৪৫০ মিলিয়ন পেজের সাজেশন্স চলে আসে; শিশুমন পরিচিত হয় পর্নোগ্রাফি নামক এক কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতির সঙ্গে।

সম্প্রতি আমেরিকার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কিশোরীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেম খেলে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ সম্প্রতি এক জরিপে বলছে, ঢাকা শহরে স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে।

৫০ শতাংশ কিশোর স্বীকার করেছে, তারা তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বোধ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখে যাচ্ছে, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস-টু-ফেস ইন্টার-অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া বেড়ে যায়। অপরাধপ্রবণতা, উদ্বেগ, একাকী থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধ্যাত্ব, নিয়মিত স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিঅ্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস- এ ধরনের প্রভাব শিশুদের মধ্যে হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে।

এর বাইরে ডিভাইস আসক্তির কারণে, মানসিক উন্মাদনা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয়, এমনকি একপর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিও নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় পর্যাপ্ত অপ্রাসঙ্গিক নোটিফিকেশন বা বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে, যা শিশু-কিশোরদের অনলাইনে যাওয়ার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। এ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে পারলে তা শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে সাহায্য করবে। অভিভাবক বা শিক্ষকদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে হবে এবং তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে হবে। সংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে তেমনি সন্তানদেরও সময় নির্ধারণ করে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বইপড়া, খেলাধুলায় শিশুদের মনোনিবেশ করা জরুরি। সেইসঙ্গে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ডিভাইস আসক্তি কমবে। সংস্কৃতি চর্চা হলো শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কদের সঠিক পথে থাকার অন্যতম মাধ্যম। আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা এখন পুরোপুরি টেলিভিশন ও মোবাইলকেন্দ্রিক। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।

ভিডিও গেমে আসক্তি থামাতে চীন সরকার এই ব্যবস্থা নিয়েছে। এই আসক্তি শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে বলে মনে করে দেশটি। দক্ষিণ কোরিয়ায় তো সরকার এমন আইন করেছে যাতে ১৬ বছরের কম বয়সি শিশুরা মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অনলাইন গেম খেলতেই না পারে। জাপানে কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।

ইন্টারনেট আসক্তির প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর জার্নালিজম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও নিউ মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিল খান ভোরের আকাশকে বলেন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সহজলভ্যতার কারণে সমাজে নানা ধরনের অপকর্ম বাড়ছে। অনলাইনে মানুষকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। ব্রাউজারে ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাচ্ছে থার্ড পার্টির কাছে। তাই এসব বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত।

ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এখন পুরো দেশ ডিজিটাল। তাই পাঠ্যপুস্তকে ইন্টারনেট অতি ব্যবহারের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়েই যেন শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল টার্মের কুফল যেন জানতে পারে।  

মন্তব্য

Beta version