দেশের শিক্ষার্থীদের ৭২ দশমিক ২ শতাংশই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই বলছেন, তাদের মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে।
সম্প্রতি ১ হাজার ৭৭৩ জন শিক্ষার্থীর ওপর চালানো এক জরিপে এমন তথ্য পেয়েছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশ। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার এই তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটি বলছে, ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের কর্মকান্ডে ইন্টারনেট কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকেই। কিন্তু ইন্টারনেট তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকাংশেই নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানসিক সমস্যায় ইন্টারনেটকে ‘পুরোপুরি দায়ী’ মনে করেন ২৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং ‘মোটামুটি দায়ী’ ভাবেন ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে মানসিক সমস্যার জন্য ইন্টারনেটকে দায়ী করেনি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টারনেটের দায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
সমীক্ষা অনুসারে, ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা বিষয়ক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ অবসর সময় কাটাতে, ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ যোগাযোগের প্রয়োজনে, ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ অনলাইন গেম খেলতে বা ভিডিও দেখতে, ১২ দশমিক ৬ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটা করতে এবং ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
জরিপ অনুসারে, তরুণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অ-ফলপ্রসূ কাজে ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করেন।
জরিপে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ জানান যে, ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাদের স্বাভাবিক জীবনে ‘প্রচন্ড নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলছে। ৫৭ দশমিক ২ শতাংশের স্বাভাবিক জীবনে ‘কিছুটা নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলছে বলে জানা যায়।
নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করেন ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ বিঘেœর জন্য দায়ী। ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ ইন্টারনেটে পর্নো দেখা, সাইবার ক্রাইম, বাজি ধরা, বুলিং করা প্রভৃতি অপ্রীতিকর কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছেন।
২৩ শতাংশ ধীরে ধীরে অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন, ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেছেন এবং ২০ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন বলে সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়।
এছাড়া লেখাপড়ার বাইরে ইন্টারনেটের কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছেন এবং ইন্টারনেটে আসক্তির কারণে পড়াশোনা হুমকিতে পড়ছেন। এছাড়াও পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতি, সামাজিক সম্পর্কেও পিছিয়ে পড়া, ব্যক্তি জীবনে বিরূপ প্রভাব, ঘুম ও শারীরিক সমস্যাসহ আচরণগত পরিবর্তনও দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের মাঝে।
জরিপে দেখা গেছে, ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসের ওপর তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার কিংবা ফলোয়ার সংখ্যা বাড়া বা কমা বিষয়ক ব্যাপারে অধিকাংশ সময়ই প্রভাব বিস্তার করেছে।
তবে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাদের আত্মবিশ্বাসের ওপর এমন প্রভাব মাঝে-মধ্যে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যের সফলতায় ১০ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনে হতাশার সৃষ্টি করেছে।
এছাড়াও সামাজিক মাধ্যম থেকে জানা অন্যের সফলতার খবর ১০ দশমিক ৫ শতাংশকে ঈর্ষাকাতর করে তোলে এবং ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। অন্যদিকে, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এ ধরনের খবর থেকে উৎসাহিত হন। তবে ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর ভেতর এই বিষয়ক খবর কোনো তারতম্যের সৃষ্টি করে না বলে জানা যায়।
জরিপের ফলাফল নিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানসেন রোজ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ অবসর সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে আমাদের তরুণ প্রজন্মই পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু সমীক্ষা অনুযায়ী তারা ইন্টারনেটকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চান। কারণ আমাদের দেশে বিনোদনের ক্ষেত্রগুলো প্রায়ই সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
পর্নো দেখা, অনলাইনে গেম খেলা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও দেখা ইত্যাদি কাজে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ যুক্ত থাকে। ইন্টারনেটে আমাদের মনোযোগ ঘুরানোর অসংখ্য উপাদান রয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে ডিজিটাল লিটারেসি না থাকায় তারা ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।’
অনলাইনে অতিমাত্রার নির্ভরশীলতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখে আসছি অনলাইনভিত্তিক অপকর্ম হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে। সাইবার ক্রাইম, ব্ল্যাকমেইল করাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ড যুক্ত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে ফেলছেন। এমনকি অনেকে আত্মহত্যা করতেও উৎসাহিত হন।’
সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘জরিপের তথ্য অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশঙ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে, যা আমাদের ভাবতে সহায়তা করবে আসলেই ইন্টারনেটের ব্যবহার এ বয়সি মানুষদের উপকার করছে নাকি অপকারটাই বয়ে নিয়ে আসছে। বিশেষ করে ১৯-৩০ বছর বয়সি যে তরুণ যুবক গোষ্ঠী আছে তাদের হতাশা, বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য সামাজিক-মানসিক অস্থিরতা আগের তুলনায় অনেক বেশি। এদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
এক্ষেত্রে ইন্টারনেট কিছুটা দায়ী বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে।’ টাঙ্গাইলের ডেপুটি সিভিল সার্জন ড. মারুফ আহমেদ খান বলেন, ‘ডিএসএম-৫ নির্দেশিকাতে দেখা যায় যে, ইন্টারনেট আসক্তি একটি ব্যাধি হিসেবে স্বীকৃত। আরো দেখা যায় যে, ইন্টারনেট আসক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা দ্বিগুণ হয়।’ সমস্যা সমাধানে আঁচল ফাউন্ডেশন কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে।
এর মধ্যে আছে ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে স্কুল, কলেজগুলোতে ‘ডিজিটাল লিটারেসি প্রোগ্রাম’ চালু করা, ইন্টারনেট রেসকিউ ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আসক্তি কাটিয়ে উঠতে কাউন্সেলিং, থেরাপি এবং শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রদান করা, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগে ইন্টারনেট নির্ভরতার পরিবর্তে সরাসরি যোগাযোগকে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালানো।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য