-->

ভলিবল থেকে ক্রিকেটার ইবাদত

শামীম হাসান
ভলিবল থেকে ক্রিকেটার ইবাদত

দলের মূল পেসার নন তিনি। হওয়ার তো কথা নয়। অন্তত অতীত পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। নিউজিল্যান্ড সফর শুরুর আগে ১০টা মাত্র টেস্ট খেলেছেন। সেখানে তার বোলিং যে আহামরি কিছু ছিল তা নয়। বরং বলা যায় অতি সাধারণ। প্রশংসার পর্যায়ে তো পড়ে না, বরং প্রশংসা অপাত্রে চলে যায়। সেই ইবাদত হোসেন কি না বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে এক ঐতিহাসিক জয়ের কাণ্ডারি হলেন। তার হাত ধরেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ।

নিউজিল্যান্ড সফরের আগে ইবাদতের পরিসংখ্যানে একবার চোখ বোলানো যাক। ১০ ম্যাচে তার উইকেট ছিল মাত্র ১১টি। ম্যাচে কখনো এক উইকেট পেয়েছেন। এমনও ম্যাচ আছে কোনো উইকেটের দেখা পাননি। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট শিকারের কীর্তি রয়েছে তার। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে যা করেছেন বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট থেকে তা কখনো মোছা যাবে না। কেননা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এটাই বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়। আর এ জয়ের রূপকার ইবাদত দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছেন ৬ উইকেট।

আর এটাই বাংলাদেশের জয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। বল হাতে নিউজিল্যান্ডকে এমন নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিলেন যে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটারদের খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি। ৮ উইকেটের বিশাল জয় নিয়ে দেশবাসীকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছেন। শুধু কি তাই, একটা আফসোস থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন। ক্রিকেট নিয়ে যে হতাশা দিনে দিনে গ্রাস করছিল তা থেকে মুক্তি মিলেছে। মুক্তি মিলবে বিদেশিদের সমালোচনা থেকেও।

ইবাদতের বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ড কুপোকাত হয়েছে। অথচ তাকে বল হাতে না দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। আসলে ইবাদতকে যে কখনো ক্রিকেটে দেখা যাবে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেননি। কেননা ক্রিকেট ইবাদতের জায়গা ছিল না। তিনি ছিলেন মূলত একজন ভলিবল খেলোয়াড়। কাল পুরস্কার বিতরণের সময় ইবাদত সে কথাই জানালেন।

ইবাদতের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। সেখানকার কাঁঠালতলী গ্রাম থেকে ওঠে এসেছেন তিনি। ছোটবেলায় যা হয় তার ব্যতিক্রম ছিলেন না ইবাদত। মৌসুম অনুযায়ী খেলা করতেন। পাড়ার মধ্যে ক্রিকেট খেলার প্রচলন থাকায় তাও খেলতেন।

তার বাবা বিজিবিতে চাকরি করতেন। স্বাভাবিক একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার পথে থাকতে হতো তার বাবাকে। বাবার নিয়মমাফিক জীবনটা ইবাদতের দারুণ পছন্দ ছিল। তাই তো বাবার দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করলেন। ২০১২ সালে যোগ দিলেন বিমানবাহিনীতে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর বুঝতে পারলেন এ জীবন তার নয়। নিয়ম-কানুন ভালো কিন্তু যেখানে খেলার ইচ্ছামতো সুযোগ নেই সেখানকার জীবনের সঙ্গে হাঁপিয়ে উঠতে লাগলেন। বল ছুঁড়বেন দূরন্ত গতিতে অথচ সেই গতিটা যে তখন আটকে গেল। তার খেলা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল কোর্টের মধ্যে। কখনো বাস্কেটবলের ছোট্ট সীমানায়, কখনো হ্যান্ডবল আবার কখনো ভলিবল। একপর্যায়ে বিমানবাহিনীর নিয়মিত ভলিবল খেলোয়াড় হয়ে যান। সেখানে ভালো করলেও দুরন্ত গতি যে নেই। ফলে ক্রিকেটকে ভুলতে পারেন না। দুর্বার গতিতে বল করার স্বপ্নটা মন থেকে মুছতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত বিমানবাহিনী তার সমর্থনে এগিয়ে আসে। তাকে তার ইচ্ছা পূরণে হাত বাড়িয়ে দেয়। ইবাদত আবার ক্রিকেট মাঠে ফেরেন। ২০১৪ সালে সিটি ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান।

দুই বছর পর ইবাদতের সামনে চলে আসে সেই সুযোগ যার জন্য তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড পেসার হান্টের আয়োজন করে। তাদের এ আয়োজন পেসারের অভাব পূরণে সারাদেশে তরুণ ক্রিকেটারদের মাঝে আলোড়ন তৈরি করে। এতে শামিল হন ইবাদত। স্বপ্ন পূরণের সুযোগ আসায় আর দেরি করেননি। ফরিদপুর থেকে তিনি পেসার হান্টে অংশ নেন।

সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রতিযোগী জাতীয় দলে খেলার আশা নিয়ে পেসার হান্টে যোগ দেয়। স্বাভাবিকভাবে ব্যাপক উত্তেজনা কাজ করছিল ইবাদতের মনে। পারবেন কি তিনি? কিন্তু তিনি পরীক্ষায় উতড়ে যান। মাত্র দুটি বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি বলের গতি ছিল প্রায় ১৪০ কিলোমিটার (১৩৯.০৯ কিলোমিটার)। আর এতেই ইবাদত স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি পেয়ে যান। নির্বাচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন।

স্বপ্নের প্রথম ধাপ পার হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে তিনি সান্নিধ্য পান পাকিস্তানের সাবেক তারকা আকিব জাভেদের। বলের গতি দিয়ে এখানেও তিনি পাস। নির্বাচকদের মন কাড়েন তিনি। শুধু তাই নয়, সে সময় পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম হন ইবাদত। প্রতিযোগীদের মধ্যে থেকে ৬৩ জনকে বাছাই করা হয়। এ সময় অবশ্য ইবাদত আগের গতি পাননি। এবার তার গতি ছিল ১৩৯ কিলোমিটার। এতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। গতির দৌড়ে প্রথম হন।

তারপর ইতিহাস রচনার পথ। সে পথে চলাটা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে অভিষেক হয়েছিল তার। এমন এক দেশে বাংলাদেশের একজন পেসারের অভিষেক কতটা কঠিন তা ক্রিকেটপ্রেমীরা ভালোই জানেন। ইবাদতও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। একটা উইকেট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। তিন বছর পর সেই নিউজিল্যান্ডে ইবাদত। এবার আর ব্যর্থতা নয়, সাফল্যের গান গেয়েছেন ইবাদত। দলকে এনে দিয়েছেন অবিস্মরণীয় এক জয়।

মন্তব্য

Beta version