সামনে ডাকছিল নতুন মাইলফলক। কিন্তু মুশফিক ছিলেন অফ ফর্মে। সাদা পোশাকে তার বিবর্ণ পারফরম্যান্স কাটাছেড়া হচ্ছিল যাচ্ছেতাইভাবে। সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এক রিভার্স সুইপ খেলে হয়েছিলেন আরও সমালোচিত। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজে এভাবে তিনি ঘুরে দাঁড়াবেন, ভাবেননি কেউ। তবে হ্যাঁ, ভেবেছিলেন একজন তিনি দলের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, শ্রীলঙ্কা সিরিজে ফিরবেন মুশফিক।
মুশফিক ঠিকই ফিরলেন রাজকীয় ঢঙে। নতুন মাইফলক স্পর্শ করলেন ৬৮ রান করে। বনে গেলেন বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে পাঁচ হাজার রানের মালিক। পরে করলেন চরম ধৈর্যশীল এক সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম টেস্টের চতুর্থ দিনটা যেন ছিল মুশফিকময়।
ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার ফরম্যাট টেস্টে দারুণ এই মাইলফলক ছুঁতে মুশফিকের দরকার ছিল ৬৮ রানের। দারুণ ব্যাটিংয়ে তৃতীয় দিনে তুলে নেন ৫৩ রান, বাকি ১৫ রান তুলতে চতুর্থ দিন সোয়া এক ঘণ্টা সময় নিলেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। তাতে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ৫ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছে গেলেন মুশফিক।
একই মাইলফলকে অবশ্য তামিম ইকবাল আগে পৌঁছাতে পারতেন। টেস্ট ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি করে ১৩৩ রানে অপরাজিত থাকা তামিম এদিনে নেমেই প্রথম বলে বোল্ড। ফলে সেই মাইলফলক আর ছোয়া হয়নি তামিমের। ৫ হাজারে পৌঁছাতে তার দরকার আর ১৯ রান।
মাইলফলকে পৌঁছানোর অপেক্ষা, মুশফিকের জন্য সময়টা নিশ্চয়ই বিশেষ। যেখানে থাকার কথা রোমাঞ্চ, আবার দুশ্চিন্তায়। কিন্তু চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যকার প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনেই কিনা তাকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি অপেক্ষায় থাকতে হলো। খেলা শুরু হওয়ার কথা ১০টায়, কিন্তু চট্টগ্রামে মঙ্গলবার রাতভর বৃষ্টি হয়। সকাল পৌনে ৯টা পর্যন্ত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়। এদিন আধা ঘণ্টা পিছিয়ে সাড়ে ১০টায় শুরু হয় খেলা।
আগের দিনের অপরাজিত সঙ্গী লিটন কুমার দাসকে নিয়ে মাঠে নামেন মুশফিক। সাবলীল শুরুর পর ধীরে ধীরে অনন্য কীর্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। এদিন কোনো তাড়া নয়, শান্ত-সুন্দর মুশফিকের দেখা মেলে। পুরোপুরি টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করে যেতে থাকেন তিনি। ১২৩তম ওভারে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। লঙ্কান পেসার আসিথা ফার্নান্দোর করা ডেলিভারিটি মুশফিকের গ্লাভস ছুঁয়ে চলে যায় ফাইন লেগে, ২ রান নিয়ে ৫ হাজার পূর্ণ করে নেন মি. ডিপেন্ডেবল।
এমন দারুণ মাইফলক ছুঁয়েও নির্লিপ্ত মুশফিক, শুরুতে থাকল না কোনো উদযাপন। সঙ্গী লিটন এগিয়ে গিয়ে জানালেন অভিনন্দন। জহুর আহমেদের ড্রেসিং রুম থেকেও এলো শুভেচ্ছা, জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠল তার ছবি ও ঘোষণা, 'প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মুশফিকের ৫ হাজার রান। হেলমেট খুলে, ব্যাট উঁচিয়ে সেটার জবার দিলেন মুশফিক। এরপর আবারও আগের ছন্দে ব্যাটিং শুরু।
মাইলফলক ছোঁয়ার তৃপ্তিতে মুশফিক নিশ্চয়ই প্রফুল্ল। একই সঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলার কথা তার। গত মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম এই ব্যাটিং কাণ্ডারি। প্রোটিয়াদের মাটিতে চার ইনিংসে ৫৯ রান করেন তিনি, সর্বোচ্চ ছিল ৫১ রান। বাকি তিন ইনিংসে তার রান ৭, ০ ও ১। ঘরের মাঠে এসে খারাপ সময়কে ছুটিতে পাঠালেন মুশফিক, সাগরিগায় গড়লেন কীর্তিও।
৮১তম টেস্ট ও ১৪৯তম ইনিংসে পাঁচ হাজারির ক্লাবে পৌঁছালেন ২০০৫ সালে ১৭ বছর বয়সে লর্ডসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু করা মুশফিক। লর্ডসের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হয়েছিল তার। চার হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছাতে মুশফিকের লেগছিল ৬৬ টেস্ট। পরের হাজার রান করতে ১৫ টেস্ট লাগলো তার।
পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করার পর মুশফিক ছিলেন আরও শান্ত। তার চোখ তখন সেঞ্চুরির দিকেও। সেটাও পেয়ে যান দারুণ এক বাউন্ডারিতে। তখন তার দেখা গেছে দারুণ উদযাপন।
বাউন্ডারি নিশ্চিত হতেই মুষ্টিবদ্ধ হাতে ঘুষি ছুড়লেন শুন্যে। আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন সতীর্থ নাঈমকে। এরপর ব্যাট ও হেলমেট নিয়ে দুই হাত করলে প্রসারিত। চুমু আকলেন প্রিয় ব্যাটে। সবুজ জমিনে এরপর দিলেন সিজদা।
সেঞ্চুরির পর মুশফিকের এমন উযদাপন বাড়াবাড়ি বলা ঠিক হবে না। কারণ সাদা পোশাকে তার সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। সর্বশেষ সেঞ্চুরি ছিল প্রায় আড়াই বছর আগে। তবে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের আগে মুশফিক নিজেকে তৈরি করেছেন নিখুতভাবে। অনুশীলন করেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
তার ফলটা তিনি পেলেন চট্টগ্রাম টেস্টে। টেস্ট ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি হাকাতে মুশফিক বল খেলেছেন ২৭০টি। এর মধ্যে বাউন্ডারি ছিল মাত্র চারটি। তার মানে ক্রিজে এই গরমের মধ্যে কতটা অটলচিত্তে খেলেছেন তিনি। ব্যক্তিগত ৯৭ রানের মাথায় ফার্নান্দোর বলে বাউন্ডারি হাকিয়ে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পৌছান তিনি।
মন্তব্য