একটা সময় দোর্দণ্ড দাপট ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। বাঘা বাঘা সব পেসারের সঙ্গে দারুণ কিছু ব্যাটার ক্যারিবীয়দের স্বর্ণযুগ বলতে গেলে অতীত। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশও এগিয়েছে। সাফল্য এসেছে বিভিন্ন জায়গা। বাংলাদেশ ও উইন্ডিজÑ দুই দলের মধ্যে এখন তারতম্য আছে, তবে খুব বেশি নয়। তারপরও দুই দলের মোকাবিলায় সবসময়ই এগিয়ে থাকে উইন্ডিজ। বিশেষ করে ক্যারিবীয় সফরে গেলেই খেই হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডেতে লড়াইয়ের ঝাঝ থাকলেও টেস্টে বিবর্ণই থাকে টাইগারদের পারফরম্যান্স।
অ্যান্টিগা টেস্ট বাংলাদেশ হেরেছে ৭ উইকেটে। এখন চলছে সেন্ট লুসিয়া টেস্ট। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট ২৩৪ রানে। জবাবে ৪ উইকেট হারিয়ে ভীষণ চাপে পড়লেও কাইল মায়ার্সের সেঞ্চুরিতে দ্বিতীয় টেস্টে শক্ত অবস্থানে রয়েছে স্বাগতিকরা। ৫ উইকেটে দলটির সংগ্রহ ৩৪০। লিড দাঁড়িয়েছে ১০৬ রানে। বিপর্যয় সামলে বড় স্কোর যেখানে গড়তে পারে উইন্ডিজ, সেখানে বাংলাদেশ কেন পারে না। শনিবার ম্যাচের দ্বিতীয় দিন শেষে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ফিরে তাকালেন শেকড়ের দিকে। এদেশের টেস্ট সংস্কৃতি এখনো প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি বলেই মনে করেন ডমিঙ্গো। উইন্ডিজের চেয়ে নিজেদের তিনি পিছিয়ে রাখছেন এখানেই। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সমস্যা বা ঘাটতির জায়গা নিয়ে যেকোনো আলোচনায় সবসময়ই উঠে এসেছে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারাকে। এদেশের ক্রিকেট প্রশাসকদের ভাবনা ও ক্রিকেট পরিচালনার ধরন, ক্রিকেটারদের মানসিকতা, সামগ্রিক ক্রিকেটীয় কাঠামো আর আবহে টেস্টের মৌলিক ব্যাপারগুলোর অনেক কিছুই অনুপস্থিত বছরের পর বছর ধরেই। টেস্টের যে আলাদা ভাষা আছে, সেটা বুঝতে পারেন না এখানকার ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট অনেকের। টেস্টের প্রক্রিয়া অনুসরণের তাগিদ চোখে পড়ে সামান্য।
উইন্ডিজের বিপক্ষে গত বছর দেশের মাঠে ও এ বছর ক্যারিবীয় সফরে বাংলাদেশ অনেকবারই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়নি। ক্যারিবিয়ানরা আবার লাগাম নিয়ে ম্যাচ জিতে গেছে। চলতি সেন্ট লুসিয়া টেস্টের দ্বিতীয় দিনেও যেমন প্রথম সেশনে উইন্ডিজকে প্রবলভাবে চেপে ধরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরে ঠিকই চাপ সরিয়ে দিনটি নিজেদের করে নিয়েছে ক্যারিবিয়ানরা। বিশ^ ক্রিকেটে উইন্ডিজ বেশ অনেক দিন ধরে ক্ষয়িষ্ণু শক্তির হলেও বাংলাদেশের চেয়ে সংস্কৃতি বেশি সমৃদ্ধ হওয়ায় তারা বারবার এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন ডমিঙ্গো। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ ভাগ থেকে আশির দশকের প্রায় পুরোটা; এমনকি নব্বইয়ের শুরুর দিকেও বিশ^ ক্রিকেটে রাজত্ব করেছে ক্যারিবিয়ানরা। এখন আগের দাপট না থাকলেও টেস্ট সংস্কৃতির রেশ তো আছেই। অসাধারণ সব পারফরমারও তারা পেয়েছে যুগে যুগে, যারা আলাদা জায়গা নিয়ে আছেন বিশ^ ক্রিকেটের ইতিহাসে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারা প্রেরণা হয়ে আছেন। রাসেল ডমিঙ্গো বলেন, ‘পুরোপুরি বলা কঠিন (বাংলাদেশের ঘাটতি কোথায়)Ñ টেস্ট ক্রিকেটে উইন্ডিজের দীর্ঘ ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে তারা বিশে^র সেরা টেস্ট দল ছিল। তারা তাই জানে, টেস্ট ম্যাচ কীভাবে খেলতে হয়। ওদের আইকনিক অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা টেস্ট ম্যাচে ভালো করেছেন। আমাদের টেস্ট ম্যাচ সংস্কৃতি এখনো সেখানেই নেই, যেখানে থাকা উচিত।’
গত বছর বাংলাদেশ সফরে যে ইতিহাস গড়েছিলেন কাইল মায়ার্স, এদেশের ক্রিকেটে তাকে সবসময় মনে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল ওটুকুই। টেস্ট অভিষেকে চতুর্থ ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করে তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। এবার সেন্ট লুসিয়া টেস্টে আরেকটি অপরাজিত সেঞ্চুরিতে দলকে টেনে তুললেন বিপর্যয় থেকে। তার এমন ইনিংস দেখে বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর কণ্ঠে খেদ, তার দলের ব্যাটসমানরা এমন বড় ইনিংস খেলতে পারছেন না! দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনে একপর্যায়ে উইন্ডিজ ছিল বিপাকে। ১০০ রানের উদ্বোধনী জুটির পর তারা ৩২ রানের মধ্যে হারায় ৪ উইকেট। কিন্তু মায়ার্স দারুণ সেঞ্চুরি করে উদ্ধার করেন দলকে। দিন শেষে মায়ার্স অপরাজিত ১২৬ রানে। এ প্রসঙ্গে ডমিঙ্গো বলেন, ‘ব্যাটিং ও বোলিংয়ে এ মুহূর্তে গুরুতর জিজ্ঞাসা আছে আমাদের। কারণ এটা কোনোভাবেই আড়াইশ রানের উইকেট নয়। শেষের ওই ৩০ রানের জুটি না হলে ১৯০ রানে অলআউট হতাম আমরা। ব্যাট হাতে যথেষ্ট ভালো পারফরম্যান্স আমরা দেখাতে পাচ্ছি না এবং উইন্ডিজ দেখিয়ে দিচ্ছে, কেন তারা আমাদের চেয়ে ভালো। ওদের একজন সেঞ্চুরি করেছে, ওরা বড় স্কোর করছে। বোলিংয়ে ওরা জুটি গড়ে বোলিং করেছে, ব্যাটিংয়েও জুটি গড়ে লম্বা সময় উইকেটে থেকেছে।’
বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যাটসম্যান নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। ফর্মে নেই তারা বেশ কিছুদিন ধরেই। যারা ভালো শুরু করছেন, তারা বড় ইনিংস খেলতে পারছেন না। তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন ২২, ২৯ ও ৪৬ রানে অথচ থিতু হওয়ার পর তার কাছে দলের দাবি থাকে বড় ইনিংস। সাকিব আল হাসান, লিটন দাসরা ফিফটি পেলেও বড় করতে পারেননি ইনিংস। ডমিঙ্গো এখানেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বললেন, মায়ার্সকে দেখে বড় ইনিংস খেলা শিখতে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশ কজন ক্রিকেটার এখন ফর্ম ও ছন্দ খুঁজে ফিরছে। এখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় লম্বা সময় ব্যাট করা। ৩০-৪০ রানের ইনিংস অনেক হচ্ছে, দু-একটা ফিফটি হচ্ছে। কিন্তু মায়ার্স যেমন ১২০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তেমন বড় ইনিংস কেউ খেলতে পারছে না। দলের রান ২৩০ আর ৪০০ হওয়ার মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই।’ ‘মায়ার্সের মতো ১২০ রানের ইনিংস খেলতে হবে আমাদের কারো। গত বছর ওরা আমাদের বিপক্ষে ৪০০ রান তাড়া করেছে চট্টগ্রামে, মায়ার্স তখন ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। আমাদের কেউ এখন তেমন বড় ইনিংস খেলতে পারছে না। মায়ার্সকে দেখে শিক্ষা নিতে হবে। টেস্ট ম্যাচ অনেক কঠিন। এরকম ভালো ব্যাটিং করতে না পারলে ভালো দলগুলো শাস্তি দেবে এবং আমাদের এখন সেই শাস্তি পেতে হচ্ছে।’
মন্তব্য