-->

ম্যারাডোনা থেকে এক পা দূরে মেসি

শামীম হাসান
ম্যারাডোনা থেকে এক পা দূরে মেসি

শামীম হাসান: ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের থেকে দেশ বড়। সত্যিই কি তাই? হয়তো সত্যি! কিন্তু ব্যক্তিটির নাম যদি হয় ডিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। নিশ্চয়ই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করবে। সত্যিই বাঁ পায়ের জাদুতে বিশ্বকে এমনভাবে মোহিত করে রেখেছিলেন, তার দেশ আর্জেন্টিনা তার নামের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। দেশটির পরিচয় ম্যারাডোনার নামেই অনেক বেশি সহজ ছিল।

 

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে একাই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। অসাধারণ সব কীর্তি গড়েছিলেন। প্রতিপক্ষের ফাউল মোকাবিলা করে দলকে একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার করা দ্বিতীয় গোল তো বিশ্বের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে একে একে ইংল্যান্ডের ছয় ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করেছিলেন। আর বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যারাডোনার সেই ছবি তো এখনো বিশ্বকাপ এলে চারিদিকে সৌরভ ছড়াতে থাকে। এক ম্যারাডোনাকে আটকাতে ছয় ছয়জন বেলজিয়ান খেলোয়াড় তাকে ঘিরে ধরে। তারপরও ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারেনি। বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, জার্মানি বাধা পার হয়ে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে আর্জেন্টিনা জয় করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।

 

তারপর একে একে পার হয়েছে ৩৬ বা তিন যুগ। কিন্তু বিশ্বকাপ আর তুলে ধরা হয়নি আর্জেন্টাইনদের। আট বছর পর সেই খরা ঘোচানোর সুযোগ এসেছিল। কিন্তু হয়নি। ফাইনালে জার্মানির সামনে কাটা পড়তে হয় তাদের। মেসির অসাধারণ পারফরম্যান্সও সেদিন দলকে ট্রফি এনে দিতে পারেনি। আট বছর পর মেসির সামনে আবার সেই সুযোগ। দুই বছর আগে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাওয়া ম্যারাডোনার পাশে এসে বসার সুযোগ তার সামনে। সুযোগ বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরার।

 

আর্জেন্টিনার খুদে জাদুকর ফুটবল মাঠ থেকে একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন। গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড। কিন্তু অপ্রাপ্তি বিশ্বকাপ ফুটবল। এই ট্রফি এখনো একবার উঁচু করে ধরতে পারেননি। যদিও ২০১৪ সালে খুব কাছ থেকে দেখে এসেছেন। ট্রফির দিকে তার সেই লোভাতুর চাহনি আজো ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে। লিওনেল মেসি এবার সেই অধরা স্বপ্ন পূরণের খুব কাছে চলে এসেছেন। দলকে কাঁধে করে পৌঁছে দিয়েছেন ফাইনালে। স্বপ্ন পূরণের দূরত্ব মাত্র আর এক ধাপ। একটা মাত্র জয়। আগামী ১৮ ডিসেম্বর রাত ১টার সময় শুরু হওয়া ম্যাচে জয় পেলে পূরণ হবে মেসির স্বপ্ন। পূরণ হবে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন। একই সঙ্গে ফুটবলভক্তদের। কেননা এমন একজন খেলোয়াড়ের একটা অপূর্ণ স্বপ্ন ফুটবলবিশ্বকে বাকি সময়টা তাড়িয়ে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক।

 

একটা মাত্র জয় থেকে দূরে দাঁড়িয়ে এখন মেসির আর্জেন্টিনা। অথচ টুর্নামেন্ট কি বাজেভাবেই না শুরু করেছিল তারা। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে এশিয়ার দল সৌদি আরবকে উড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু তাদের কাছেই কিনা মেসিরা নাস্তানাবুদ হলো। মাত্র পাঁচ মিনিটের এক ঝড়ে আর্জেন্টিনাকে তছনছ করে দিয়েছিল সৌদি আরব। যদিও মেসির পেনাল্টি গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিরতির পর সৌদি আরব দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে, এবারের বিশ্বকাপে মেসির জন্য সৌদি আরব ম্যাচ যেন সেই কলঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবার ভিন্ন বিচারে সৌদি আরবের বিপক্ষে শুরুতে ওই হার যেন আর্জেন্টিনার জন্য সতর্কসংকেত। যে সংকেতে মেসিরা পরে সাবধান হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন। তারপর তো মেসি একের পর কীর্তি গড়ে চলেছেন। গ্রুপ পর্বে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড বাধা পার হয়েছে।

 

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জয় পেয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনাল তো বড় কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছিল। মেসিকে তাতিয়ে তোলার জন্য সব কাজই করেছিল ইউরোপিয়ান দল নেদারল্যান্ডস। বাদ ছিলেন তাদের কোচ লুই ফন গাল। ম্যাচের আগে মেসির সমালোচনা করেছিলেন। আর মাঠে লেলিয়ে দিয়েছিলেন তার ছেলেদের। মেসিকে ইচ্ছামতো কথার বাণে বিদ্ধ করে মনোসংযোগে চিড় ধরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেসির তো এবার একটাই লক্ষ্য। বিশ্বকাপ ট্রফি। ফলে কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। ট্রফির সঙ্গে ব্যবধান মঙ্গলবার রাতে আরো এক ধাপ কমিয়ে এনেছেন মেসি এবং সতীর্থরা। ফুটবল বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বিশ্বকাপ ট্রফির জন্য মেসি কতটা উন্মুখ হয়ে আছেন। গোল করেছেন আবার করিয়েছেন।

 

মঙ্গলবার রাতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচে আর্জেন্টিনার করা তিনটি গোলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। একটা নিজে করেছেন। আর একটা করিয়েছেন। অন্য গোলেও তার অবদান রয়েছে। কিন্তু গোল করার আগে বল প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সংস্পর্শ আসায় অ্যাসিস্ট হিসেবে মেসির নাম কাটা পড়েছে। তবে এতে মেসির অবদান এতটুকু কমতি হয়নি। বরং মেসি বিশ্বকাপে তার সেরা ম্যাচ খেলেছেন কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অসাধারণ কীর্তিতে তিনি আলভারেজকে দিয়ে দলের তৃতীয় গোলটি করান। এখন অপেক্ষা আর একটা জয়ের। এ জয়ে মেসি যেমন স্বস্তি পাবেন, তেমনি তার সমর্থকরা। শুধু তাই নয়, এমনকি ফুটবল বিশ্বও। কেননা এমন একজনের হাতে বিশ্বকাপ না থাকলে মানায় না।

মন্তব্য

Beta version