মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: কে তারে মনে রাখে, যে তারা গেল ঝরে? সর্বক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য নয়। কিছু নক্ষত্রের পতন হয় না কখনো। নয়নের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেও তারা থেকে যান হৃদয়ে। এসব নক্ষত্র সর্বক্ষণ সর্বদা মনমন্দিরে আলো ছড়াতে থাকে।
তাদের ক্ষেত্রে বরং এ কথাটি প্রযোজ্য তুমি সন্ধ্যাকাশে তারার মতো আমার মনে জ্বলবে। তেমনি এক উজ্জ¦ল নক্ষত্র পেলে। চাইলেও তাকে কোনো দিন ভুলতে পারবে না ফুটবল বিশ্ব। পারবে না পৃথিবী। যতদিন পৃথিবী থাকবে, ততদিন ফুটবলাকাশে দ্যুতি ছড়াবেন মাঠে পায়ের জাদু দেখানো সদ্য অসীমে পাড়ি জমানো এ তারকারদের তারকা।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর, দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলে বলেছিলেন, ‘একদিন আমরা নিশ্চয়ই একসঙ্গে ফুটবল খেলব, ওই দূর আকাশে।’ ঠিক ৭৬৪ দিন পর ক্যান্সরের সঙ্গে লড়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে তিনিও পৃথিবী ছাড়লেন। ফুটবলের সবচেয়ে বড় নক্ষত্রকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে দূর আকাশে হয়তো আজ আনন্দের বন্যা বইছে, হয়তো তাকে স্বাগত জানাতে ফুটবল হাতে মাঠে নেমে গেছেন স্বয়ং ম্যারাডোনাই, কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠে, মর্ত্যরে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের কালো ছায়া।
পেলের চলে যাওয়ায় কাঁদছে ব্রাজিলের আকাশ-বাতাস, কাঁদছে সারা পৃথিবী। প্রিয় পেলেকে হারানোর ব্যথা মানতে পারছেন না কেউই। পেলে ছিলেন ফুটবলের রূপকথার রাজপুত্র। গরিব ঘরের ছেলে পেলে। মা-বাবা দুজনই অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। অন্য বাচ্চারা যখন বাবা মায়ের কাছে নানা আবদার ধরতে ব্যস্ত। নানা ধরনের শখ মেটাতে মরিয়া তখন পেলের এক সংগ্রমী জীবন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনিও কাজ করেন। স্রষ্টা প্রদত্ত ভাগ্য নিয়ে অনেকেরই ভিন্ন মতবাদ রয়েছে।
নিজের জীবনকে কেউ পুরোপুরিভাবেই ভাগ্যের ওপর সমর্পণ করে বসে, কেউ আবার এমনটা বিশ্বাস করেন যে আত্ম চেষ্টায় ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব, কেউ কেউ আবার ভাগ্যের ওপর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে রাজি নন। কিন্তু চেষ্টায় কারো কারো ভাগ্য ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। ফুটবলের রাজা পেলে ঠিক তেমন একজন।
ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েসে ১৯৪০ সালের ২১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া পেলের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে খেলার। কিন্তু দরিদ্রতা যেন তাকে স্বপ্ন দেখতেও বারণ করত। তার মা-বাবা দুজনই বাইরে কাজ করতেন। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে তাকেও ঘর মোছার কাজে যেতে হতো।
যেভাবে ডিকো থেকে পেলে হলেন : পেলের ডাক নাম ডিকো। এক মজার ঘটনার মধ্য দিয়ে তার নাম হয় পেলে। সেই গল্পটি এরকম। ডিকো তার মায়ের সঙ্গে একদিন কাজে গিয়েছিল এক বড় লোকের বাড়িতে। কাজ করার সময় বাড়ির মালিকের ছেলে ও বন্ধুদের মুখে সে শুনতে পায় সান্তোস ক্লাবে নতুন খেলোয়াড় নিচ্ছে। মালিকের ছেলে ও তার বন্ধুদের এসব কথোপকথন খুব মন দিয়েই শুনছিল ডিকো। মালিকের ছেলে তখন বললো জানিস, আমি ইতালির মেজ্জোলার মতো খেলি, আমি চান্স পাবই।
ঘর মুছতে মুছতে ১১ বছরের বালক ডিকো হুট করে বলে বসল, আমি পেলের মতো খেলি। ওরা তো হেসে লুটোপুটি। পেলেটা আবার কে? কোনোদিন তো এর নাম শুনিনি। ডিকোর তখন পেলেকে চিনিয়ে দেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, ভাস্কদা যিনি গোলকিপার। মালিকের ছেলে বলল, আরে গর্দভ উনার নাম তো বিলে, পেলে না। মালিকের ছেলের এক বন্ধু বলে উঠে চল ওর নাম পেলে রেখে দিই। ঠিক তখন থেকেই ডিকোর নাম হয়ে বসল পেলে!
যে নামে ডাকলে তার প্রচুর মন খারাপ ও রাগ হতো। কিন্তু তার এ ব্যঙ্গাত্মক নামটাই যে এক দিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তা কেউ কি ভেবেছিল তখন! সেই পেলেই কিনা পরবর্তীতে হলেন ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও তিনবার বিশ্ব কাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার। ফুটবলের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ ছিল পেলের। একটু সময় পেলেই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মেতে উঠতো ফুটবলে।
একটা সময় পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি ইনকামের জন্য জুতা সেলাই ও জুতাতে কালি করার কাজও পর্যন্ত তাকে করতে হয়েছে। জুতা সিলাইয়ের কাজ বাদ দিয়েই মাঝে মাঝে ফুটবলে মেতে উঠত সে। মা অবশ্য একদমই পছন্দ করতেন না এসব। গরিবের ঘোড়া রোগ হবে কেন! তারা দরিদ্র! কাজ করে খেতে হবে। এভাবেই চলে যাবে জীবন। ভয় ছিল আরো একটা। পেলের বাবাও একজন ফুটবলার ছিলেন, কিন্তু বার বার ইনজুরিতে পরার কারণে তার আর সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, ইনজুরির কারণেই তার ক্যারিয়ারটাই নষ্ট হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই পেলের পরিবারে আর্থিক সমস্যাটা আরো বেশি দেখা দিয়েছিল। তাই ফুটবল নিয়ে পেলের অনেক বড় স্বপ্ন থাকলেও পরিবার থেকে কোনো আর্থিক সাপোর্ট পাচ্ছিল না সে।
মনেপ্রাণে যার ফুটবল তাকে কে দাবিয়ে রাখে। প্রায় ১১ বছর বয়স তখন, পেলেদের পাড়ার টিমের সঙ্গে স্থানীয় একটি ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৬ টিমের খেলা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো বিপক্ষ ক্লাবটিতে ছিল সেই মালিকের ছেলে। বিপক্ষ দলের কোচ, শৃঙ্খলা, খেলার সব পোশাক সব থাকলেও জুতা-মোজাহীন পেলেদের কাছে স্থানীয় ফুটবল ক্লাবটি সেদিন ৫-৬ গোলে হেরে গিয়েছিল। সেদিনই পেলে তার ফুটবলের নিখুঁত নৈপুণ্যতা দেখিয়ে মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। মূলত এখান থেকেই পেলেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিছু বছর পর ক্লাব সান্তোস ও পরবর্তীতে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় পেলের।
চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় (১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই)। মারাকানায় অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ব্রাজিল হারে ২-১ গোলে। যদিও সেই ম্যাচে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার নাম লিখিয়ে ফেলেন পেলে। পেলের জীবন ছিল পূর্ণতায় ভরপুর। ছিল না কোনো অপ্রাপ্তি। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপে পেলের পায়ের ছন্দে এবং পুরোনো সেই জিঙ্গা স্টাইলে কুপোকাত হয়ে বসে সেই সময়ের শক্তিশালী দল সুইডেন।
ইতিহাস গড়ে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তুলে নেয় ব্রাজিল। সেইসঙ্গে বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে ৮ বছর আগে পেলে তার বাবাকে দেয়া কথা রাখে। গোটা ব্রাজিলের জন্য এক অনন্ত আক্ষেপের নাম ১৯৫০ বিশ্বকাপ। সেবার ফাইনালে হারার পর পেলে তার বাবাকে কাঁদতে দেখে বলেছিল ‘কেঁদো না বাবা আমি তোমাকে পরের বিশ্বকাপ এনে দেব।
ব্রাজিলের হয়ে তিনি ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালে মোট ৪টি বিশ্বকাপ খেলার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৬ সাল বাদে বাকি ৩টি বিশ^কাপ তার হাত ধরেই জয় পায় ব্রাজিল। জাতীয় দলের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল (বিশ্বকাপ ১২ গোল), লিগ ম্যাচে ৬৯৪ ম্যাচে ৬৫০ গোল, মোট ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮১ গোল করেন তিনি। যার শুরু আছে তার শেষ আছে। এক দিন সবকিছু থেমে যায়।
থেমে যায় মানুষের জীবন। তেমনি ৮২ বছরের পৃথিবী ভ্রমণ শেষ হয়েছে ফুটবলের রাজা পেলের। ফিরে গেছেন সাজঘরে। আজ পৃথিবী কাঁন্নায় নিমগ্ন। ফুঠবল প্রিয় প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক দিন এ ক্ষত শুকিয়ে যাবে। কিন্তু পেলের প্রতি টানটান অনুভ‚তি ফুরাবে না কখনো।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য