জয়ের সুবাস পেয়ে গ্যালারিতে উল্লাস চলছিল অনেকক্ষণ ধরেই। ম্যাচ শেষ হতেই সেই উচ্ছ্বাসে যেন নতুন প্রাণের দোলা লাগল। মাঠের ভেতরে তখন নানা আবেগের স্রোত। কেউ ডানা মেলে উড়ছেন, কেউ দিগিবিদিক ছুটছেন। দেশের পতাকার দুই প্রান্তে ধরে ছুটে গেলেন দুজন। মারুফ মৃধাকে কাঁধে তুলে নিলেন কেউ একজন। শেষ উইকেটটি নিয়ে অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিম হাঁটু গেঁড়ে বসে হাত দিয়ে ঢেকে রইলেন মুখ। যেন মুহূর্তটি অনুভব করতে চাইলেন প্রাণভরে। সব মিলিয়ে দুবাইয়ের গ্যালারি থেকে মাঠে একাকার লাল-সবুজের শিরোপা উৎসব।
এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে গতকাল রোববার ভারতকে উড়িয়ে শিরোপা ধরে রাখল বাংলাদেশ। ফাইনাল জয়ের আনন্দ তো এমনিতেই উত্তঙ্গে। প্রতিপক্ষ যখন ভারত, সব পর্যায়ের ক্রিকেটেই উত্তেজনাটা পৌঁছে যায় যেন অন্য মাত্রায়। সব প্রাপ্তিকে এক বিন্দুতে মিলিয়েই ৫৯ রানের জয়ে নিজেদের রাঙাল বাংলাদেশের যুবারা। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে যদিও বড় পুঁজি গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। ১৯৮ রানেই শেষ হয় ইনিংস। মাঝ-বিরতিতে সম্ভবনায় তাই এগিয়ে ছিল ভারতই। তবে বাংলাদেশ ফিল্ডিংয়ে না হার না মানা মানসিকতায়। ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায় ছিল বারুদ, বোলিংয়ে ছিল আগুন। এই বিস্ফোরণেই ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ চূর্ণ হয়ে গেল স্রেফ ১৩৯ রানে।
টুর্নামেন্টের প্রথম ৯ আসরে একবারও শিরোপা জিততে না পারা বাংলাদেশ গত আসরে খরা ঘোচানোর পর এবার জিতে নিল টানা দ্বিতীয় শিরোপা।
ফাইনাল পর্যন্ত দলকে ব্যাটিংয়ে টেনেছেন বলতে গেলে আজিজুল। ফাইনালে তিনি বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। তবে কয়েকজনের সম্মিলিত অবদানে কিছুটা লড়ার মতো রান পায় দল। এরপর বাকি দায়িত্ব নিয়ে নেয় দুর্দান্ত পেস আক্রমণ। টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ বোলিং করা ইকবাল হোসেন ইমন জ্বলে ওঠেন ফাইনালেও। আল ফাহাদ, মারুফ মৃধা, রিজান হাসান যথারীতি ছিলেন কার্যকর। ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা পুষিয়ে বোলিংয়ে তিন উইকেট নেন আজিজুল। সঙ্গে তার ঠান্ডা মাথায় কুশলী নেতৃত্ব তো ছিলই। সেমি-ফাইনালে চার উইকেট নিয়ে ম্যাচ-সেরা হওয়া ইমন ফাইনালেও সেরার স্বীকৃতি পান ৩ উইকেট। আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি (৫ ম্যাচে ১৩টি) হয়ে ম্যান অব দা টুর্নামেন্টও ১৮ বছর বয়সী এই পেসার।
ফাইনালে বাংলাদেশ আগে ব্যাটিংয়ে নামে টসে হেরে। সকালের উইকেটে আর্দ্রতা কাজে লাগিয়ে আঁটসাঁট শুরু করেন ভারতীয় পেসাররা। ম্যাচের প্রথম ওভারে যদিও একটি ছক্কা আসে জাওয়াদ আবরারের ব্যাট থেকে। তবে প্রথম সাত ওভারে বাউন্ডারি ছিল ওই একটিই। এর মধ্যে ইউধাজিত গুহর দারুণ ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান কালাম সিদ্দিকি। অধিনায়ক আজিজুল ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলেই জোরাল আবেদন থেকে বেঁচে যান। রিপ্লে দেখে যদিও আউট বলেই মনে হচ্ছিল। পরে নিখিল কুমারকে ছক্কা মেরে পাল্টা আক্রমণে চেষ্টা করে তিনি। আরেক প্রান্তে জাওয়াদকে ২০ রানে বিদায় করেন চেতান শার্মা। ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে রানের গতি কমে আসে অনেকটা। সেটিরই বলি হন আজিজুল। স্লগ সুইপে ছক্কা মারার চেষ্টায় বাংলাদেশ অধিনায়ক আউট হন ১৬ রান করে। বিপদে থাকা দলকে কিছুটা উদ্ধার করেন মোহাম্মাদ শিহাব জেমস ও রিজান হাসান। চতুর্থ উইকটে ৬২ রানের জুটি গড়েন দুজন। তবে ইনিংস বড় করতে পারেননি কেউ। ৬৭ বলে ৪০ রানে আউট হন জেমস। দারুণ খেলতে থাকা রিজান বিদায় নেন ৬৫ বলে ৪৭ রান করে। এরপর আর কোনো জুটি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এক প্রান্ত আগলে ৩৯ রান করে দলকে দুইশর কাছে নিয়ে যান কিপার-ব্যাটসম্যান ফরিদ হাসান। রান তাড়ায় ভারতের বড় ভরসা ছিলেন তাদের দুই ওপেনার। কিন্তু বিপজ্জনক দুই ব্যাটসম্যানকেই দ্রুত ফেরায় বাংলাদেশ। রাঞ্জি ট্রফিতে এবার মুম্বাইয়ের হয়ে দুটি সেঞ্চুরি করে সাড়া জাগানো ১৭ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান আয়ুশ মাত্রে ১ রানেই বোল্ড হয়ে যান ফাহাদের ভেতরে ঢোকা বলে। আইপিএলে কোটি রুপিতে দল পেয়ে আলোড়ন তোলা ১৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান বৈভাব সুরিয়াভানশি দুটি চার মারেন মারুফ মৃধার তিন বলের মধ্যে। তবে পরের বলেই স্লোয়ারে তাকে ফিরিয়ে দেন মারুফ। পরের তিন ব্যাটসম্যানই আউট হন ২০ ছুঁয়ে। আন্দ্রে সিদ্ধার্থকে ২০ রানে বোল্ড করেন রিজান, ভালো শুরু করা কেপি কার্তিকেয়াকে ২১ রানে থামান ইমন। দারুণ বোলিং করা এই পেসার এক বল পরই ফিরিয়ে দেন নতুন ব্যাটসম্যান নিখিল কুমারকে। দীর্ঘক্ষণ একপ্রান্ত আগলে রাখা ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মাদ আমানকে (৬৫ বলে ২১) বোল্ড করে দিয়ে ভারতের সম্ভাবনা একরকম শেষ করে দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আজিজুল।
এরপর কেবল শেষের অপেক্ষা। লোয়ার অর্ডারে হার্দিক রাজ ও চেতান শার্মা একটু অপেক্ষা বাড়ান বাংলাদেশের। তার পরও ভারতের ইনিংস শেষ কেবল ৩৫.২ ওভারেই। বাংলাদেশের উদযাপন চলে লম্বা সময় ধরে। গ্যালারিতে দর্শক যত ছিলেন, বেশির ভাগই ছিলেন বাংলাদেশের সমর্থক। তাদের কাছে গিয়ে ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতা জানান ক্রিকেটাররা। ২০২০ যুব বিশ্বকাপজয়ী বাংলাদেশ দলের কোচ নাভিদ নাওয়াজের কোচিংয়েই এই দলটি তৈরি হচ্ছে ২০২৬ যুব বিশ্বকাপের জন্য। আসরটি হবে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ায়।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ : ৪৯.১ ওভারে ১৯৮ (জাওয়াদ ২০, কালাম ১, আজিজুল ১৬, শিহাব ৪০, রিজান ৪৭, দেবাশিস ১, ফরিদ ৩৯, সামিউন ৪, আল ফাহাদ ১, মারুফ ১১*, ইমন ১; ইউধাজিত ৯.১.-১-২৯-২, চেতান ১-০-০-৪৮-২, নিখির ৫-১-১৩-০, কিরান ৭-০-১৯-১, হার্দিক ১০-০-৪১-২, কার্তিকেয়া ৭-০-৩৭-১, আয়ুশ ১-০-৯-১)।
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ : ৩৫.২ ওভারে ১৩৯ (আয়ুশ ১, বৈভাব ৯, সিদ্ধার্থ ২০, কার্তিকেয়া ২১, আমান ২৬, নিখিল ০, হারভানশ ০, কিরান ১, হার্দিক ২৪, চেতান ১০*, ইউধাজিত ৫*; মারুফ ৬-০-২৩-২, ফাহাদ ৮-০-২৩-১, রিয়াজ ৮-২-১৩-০, ইমন ৭-১-২৪-৪, সামিউন ৫-০-১৫-০, আজিজুল ২.২-১-৮-৩)।
ফল : বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল ৫৬ রানে জয়ী।
ম্যান ব দা ম্যাচ : ইকবাল হোসেন ইমন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য