গাইবান্ধা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫ ০৫:০১ পিএম
জিএম চৌধুরী মিঠুর প্রয়াণে গাইবান্ধায় নাগরিক শোকসভা
জিএম চৌধুরী মিঠু, যিনি শুধু একটি নাম নন, একটি আদর্শের প্রতিচ্ছবি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে মৌলবাদের কোনো স্থান নেই, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করবে এবং যেখানে সমাজের মূল ভিত্তি হবে উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। তার এই স্বপ্ন কেবল ব্যক্তিগত আকাঙ্খা ছিল না বরং ছিল একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জাতি গঠনের গভীর প্রত্যয়। বুধবার (১১ জুন) সকাল ১১টায় গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে জিএম চৌধুরী মিঠুর প্রয়াণে নাগরিক শোকসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
নাগরিক শোকসভা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ওয়াজিউর রহমান রাফেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে কালো ব্যাজ ধারণ, প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, শোক বইতে শোকানুভূতি লেখা, নীরবতা পালন, নিবেদিত গান-কবিতা পাঠ ও স্মৃতিচারণ-আলোচনায় অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ গণমাধ্যমকর্মীরা। এসময় প্রয়াত মিঠুর পুত্র-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
স্মৃতিচারণ ও আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, মিঠু তার জীবদ্দশায় সবসময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মৌলবাদ একটি সমাজকে পিছিয়ে দেয়, বিভেদ তৈরি করে এবং মানবিক মূল্যবোধকে ক্ষুন্ন করে। উদারনৈতিক মূল্যবোধের প্রতি মিঠুর অঙ্গীকার ছিল অবিচল। তিনি সবসময় মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা এবং প্রগতিশীল ধারণাকে সমর্থন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজে আলোচনার পরিসর থাকা আবশ্যক, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয় এবং নতুন ধারণাকে স্বাগত জানানো হয়। তার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অনেক মানুষের কাছে অনুসরণীয় করে তুলেছিল।
জিএম চৌধুরী মিঠু একাত্তরের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে সচেষ্ট ছিলেন। এই কাজে তিনি কেবল মৌখিকভাবেই নয়, কর্মেও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসার এবং মৌলবাদের প্রতিরোধ।
সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ক্রীড়া সংগঠক, গণমাধ্যমকর্মী ও বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক গোবিন্দলাল দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল হক শাহজাদা, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক মইনুল ইসলাম পল, সাহিত্যিক সুলতান উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা আদর্শ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মমতাজুর রহমান বাবু, গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু, রাজনীতিক রেবতী মোহন বর্মন, লেখক রুপম রশিদ, সাবেক বাসদ নেতা শহীদুল ইসলাম, রাজনীতিক আহসানুল হাবীব সাঈদ, জিয়াউল হক জনি, প্রয়াত মিঠুর বন্ধু সমাজকর্মী গোলাম রব্বানী মুসা ও প্রবীর চক্রবর্তী, রাজনীতিক মঞ্জুর আলম মিঠু, রাজনীতিক আব্দুল্যাহ আদিল নান্নু, সাংস্কৃতিককর্মী আলমগীর কবীর বাদল, আলাল আহমেদ, শাহ আলম বাবলু, শামীম খন্দকার, মানিক বাহার, জুলফিকার চঞ্চল, শফিকুল ইসলাম রুবেল, নারীনেত্রী সাংবাদিক রিক্তু প্রসাদ, উদীচীর মিতা হাসান, চেম্বারের পরিচালক সুজন প্রসাদ, শুভানুধ্যায়ী উৎপল সাহা ও কৃষিবিদ মোস্তফা নুরুল ইসলাম রেজা, উন্নয়নকর্মী মোদাচ্ছেরুজ্জামান মিলু এবং প্রয়াত জিএম চৌধুরী মিঠুর পরিবারের পক্ষে তাঁর বড় ভাই শামীম চৌধুরী। শোকসভায় নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি দেবাশীষ দাশ দেবু, রজতকান্তি বর্মন ও শিরিন আক্তার। নাগরিক শোকসভা সঞ্চালনা করেন সাবেক ছাত্রনেতা সাংবাদিক কায়সার রহমান রোমেল।
উল্লেখ্য, গত ২৩ মে অসুস্থতাজনিত কারণে জিএম চৌধুরী মিঠু মৃত্যুবরণ করেন। গাইবান্ধায় স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম সাহসী ছাত্রনেতা ছিলেন জিএম চৌধুরী মিঠু। তিনি ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় রূপকার ছিলেন। তৎকালীন সরকারের হুলিয়া ও বিভিন্ন সংস্থার হুমকি মাথায় নিয়ে বাড়ির বাইরে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। জিএম চৌধুরী মিঠু ১৯৬৯ সালে গাইবান্ধা শহরের ভিএইড রোডে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল মজিদ চৌধুরী (যোশেপ চৌধুরী) ও মায়ের নাম মাসুদা চৌধুরী রেণু। জিএম চৌধুরী মিঠু ১৯৮৮ সালে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, গাইবান্ধা জেলা শাখার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৯ সালে বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটি গঠন করেন। আমৃত্যু এই সংগঠনের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। এই সংগঠনের ব্যানারে প্রতি বছর ভয়াল ২৫ মার্চ কালরাতের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতেন জিএম চৌধুরী মিঠু। তিনি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। পৌর শহরের ৮নং ওয়ার্ডের দুইবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর জিএম চৌধুরী মিঠু গাইবান্ধা পৌরসভার প্যানেল মেয়র ছিলেন।
ভোরের আকাশ/জাআ