রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেছেন, জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে রংপুর সবার আগে আছে। সামনের দিনেও এগিয়ে থাকবে। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। আমাদের ছেলের সাহসী রক্তদানের পথ ধরেই এদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ বিদায় হয়েছে। আর জুলাই আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর হিসেবে এই আন্দোলনকে আপটু মার্কে নিয়ে গেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সুদুর লন্ডনে বসে তিনি বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে এবং মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছেন। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদবিরোধী চূড়ান্ত বিজয় লাভ করলেও এ আন্দোলকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিএনপি নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিনের ত্যাগের বিষয়টি সবার জানা। গুম, খুনসহ, হাজারো মামলায় জর্জরিত হয়েছে বিএনপির শীর্ষ থেকে একেবারেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এখনো বিএনপি’কে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হচ্ছে। দৈনিক ভোরের আকাশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দেওয়া এক বিশেষ লাইভ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ভোরের আকাশের বার্তা সম্পাদক মো. জাহিদুল ইসলাম শিশির-ভোরের আকাশ : নির্বাচনের এখনো কোনো পরিষ্কার রোডম্যাপ বা দিনক্ষণ পাওয়া গেল না। আপনার ভাবনা কী?সাইফুল ইসলাম : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনে বিএনপি সম্মুখ সারিতে ছিল। বলতে পারেন, দেশ ও জনগণের ভালো যা কিছু হয়েছে, তার সবখানে বিএনপির অবদান রয়েছে। এখন বিএনপিকে নতুন করে ভোটের অধিকারের জন্য কথা বলতে হচ্ছে, আন্দোলন করতে হচ্ছে। আপনারা জানেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশের জনগণ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এর আগে জনগণ ভুলতে বসেছিল যে তারা এদেশের মানুষ। এখানে তাদের জন্য ন্যূনতম স্পেস রয়েছে, সে কথা বলতে পারবে। স্বাধীনভাবে পথ চলতে পারবে। জনগণ ভুলতে বসেছিল তাদের সব অধিকারের কথা। ফ্যাসিস্ট সরকার সবকিছুকে এক কেন্দ্রে এনে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে নগ্নভাবে ব্যবহার করে মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়ার চূড়ান্ত অবস্থা তৈরি করেছিল। সেই অবস্থার প্রতিবাদ করাই আমাদের দলের চেয়ারপারসন আপসহীন নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালো জিয়াকে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হয়। মিথ্যে মামলায় তাকে জেলে আটেকে রাখা হয়; যা কল্পনাতীতি এক অধ্যায়। মিথ্যে মামলায় আসামি সাজিয়ে তারেক রহমানকে দেশান্তরী করা হয়। সে এক দুঃসহ সময়। মামলার পর মামলা দিয়ে তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ বন্ধ করা হয়। সব মিলে বন্দি করা হয় দেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চার সব অধ্যায়। জনগণের পক্ষে যা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। জুলাই বিপ্লবের এক বছর পরে এসে এখন আবার বিএনপিকে নির্বাচনের জোর দাবি তুলতে হচ্ছে। আর এই দাবি তোলা নিয়ে দলটিকে কেউ কেউ সমালোচনা করার চেষ্টা করছেন। এটাও এক ধরনের ষড়যন্ত্র। বিএনপি নিজের জন্য শুধু নির্বাচনের দাবি সামনে আনছে এমন নয়। এটি এখন গণমানুষের দাবি। মানুষ বহুদিন কথা বলতে পারেনি। ভোট দিতে পারেনি। এখন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি সহসা আমরা একটি পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণ যোগ্য নির্বাচন পাব। এ নিয়ে পানি ঘোলা করতে অনেক পক্ষ কাজ করছে । কিন্তু বিএনপি এদেশের গণমানুষের দল। কারো পক্ষে গণদাবি ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এখনতো দেশে অনেকটাই নির্বাচনমুখী একটা আবহ তৈরি হয়েছে। ভোরের আকাশ : রংপুরকে বলা হয় জাতীয় পার্টির দুর্গ। এখন সেখানে বিএনপির কী অবস্থা?সাইফুল ইসলাম : এক কথায় বলা যাবে- রংপুর এখন বিএনপির দুর্গ হয়ে উঠেছে। অতীতের রংপুর আর এখনকার রংপুর এক নয়। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের হত্যার যে চিত্র রংপুরবাসী দেখেছে তা কেউ মেনে নিতে পারিনি। সে ঘটনার পর থেকে রংপুরের ফ্যাসিস্টের দুর্গ ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে। ফ্যাসিস্টদের অন্যতম দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকেও মন থেকে মুছে ফেলেছে রংপুরবাসী। আপনারা জানেন, সে সময় রংপুর অঞ্চলের সব ঘর থেকে মা বোনেরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। এই সময় বিএনপি রাজনৈতিকদল হিসেবে যে রোল প্লে করেছে তা মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এখন রংপুরে বিএনপিকে ঘিরে এক ধরনের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূতির্তে দলের চেয়ার পারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমন যে বক্তব্য রেখেছেন তা আপনারা দেখেছেন। জাতি এ বক্তব্যে অনেক বেশী আশাবাদী হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমরা দলের আদর্শ এবং নির্দেশনা মেনে দলকে গণমানুষের আস্থার ঠিকানা করে তুলতে কাজ করছি। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে। এখন নেতাকর্মীরা অনেক বেশি সুসংগঠিত। আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশনায় নতুন বাংলাদেশের পথ চলায় বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী বিশ্বাস করে দেশকে একটি সম্মান জনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বিএনপিকে পালন করতে হবে। কারণ ফ্যাসিবাদী শাসকরা দেশের গুম খুন, অনাচার, মানুষের কণ্ঠ রোধের যে নির্মম ইতিহাস রেখে গেছে সে ভয় থেকে জাতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে বিএনপিকেই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চায় জনগণ। কারণ জনগণ জানে এদেশের প্রতিটা ভাল কাজের সাথে বিএনপি তথা জিয়া পরিবারের অবদান রয়েছে। জিয়া পরিবারের হাত ধরেই দেশ স্বাধীনতা পেছে, গণতন্ত্র, বহুদলীয় পথ, সংসদ সব পেয়েছে। শহীদ জিয়ার ১৯ দফকে আরো যুগোপযোগী করে তারেক রহমান ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন; যা দেশ পরিচালনার গাইড লাইন হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আগামী দিনের বাংলাদেশ অবশ্যই সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ স্থান হয়ে উঠবে।ভোরের আকাশ: রাজনীতিতে এ সময়ে কোন শঙ্কা দেখছেন কিনা?সাইফুল ইসলাম: আগেও বলেছি। বাংলাদেশের রাজনীতির পথ বিএনপির জন্য কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি। তবে দেশের যে কোন সংকটে সামনে এসে দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে জিয়া পরিবারকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। শেখ হাসিনার চরম নির্যাতন নিপীড়ন, গুম খুন আয়না ঘরের মতো কালো অধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতাকর্মীরাই জীবন বাজি রেখেছে। সে ধারাবাহিকতায় জুলাই অন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। কিন্তু দোসররা রয়ে গেছে। তারা নানা কূটচালে বিএনপিকেও রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার ষড়যন্ত্রে মেতে রয়েছে। কিন্তু জনগণ সবসময় বিএনপিকে ভালবেসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিএনপির ডাকে সারা দেশে যে কোন সময়ে মানুষ মাঠে নামে। প্রয়োজন হলে আবারো নামবে। তবে একটা কথা সত্য লন্ডনে প্রফেসর ইঊনূস তারেক রহমানের বৈঠকের পর রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এখন বিএনপি এদেশের মানুষের আস্থার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। মানুষের এই জাগরণকে কোন কিছু দিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন নিয়ে নানা কথা হলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আমি আপাতত কোন শঙ্কা দেখি না।ভোরের আকাশ: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদসাইফুল ইসলাম: দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকা পরিবারের জন্য আমার পক্ষ থেকে এবং আমার দল বিএনপির পক্ষ থেকে নিরন্তর শুভেচ্ছ ও শুভ কামনা।ভোরের আকাশ/এসএইচ
১ সপ্তাহ আগে
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতির পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। নানা গুঞ্জনেরও ডালপালা মেলে। অনেকের মনে ছিল অজানা আশঙ্কা। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে বৃহস্পতিবার। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভিডিও বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে কষে চড় মেরেছে ইরান’। শুধু তা-ই নয়, ইরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল তেহরানকে ভয় দেখানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করানো। কিন্তু ইরান আত্মসমর্পণ করবে না। তারা সাহসী জাতি এবং লড়ে যাবে। তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক বৈ কী। দেশের মানুষকে সাহস দেওয়া, দৃঢ় ঐক্যবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল অন্যতম লক্ষ্য।রাজনীতিকদের অনেক কথাই বলতে হয়। তারা পরিস্থিতি অনুসারে অনেক কথাই বলে থাকেন। সেগুলো কেবল কথার কথা। কিন্তু ‘যুক্তরাষ্ট্রকে কষে চড় মেরেছে ইরান’- খামেনির এই বক্তব্য নিছক কথার কথা নয়। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। সুপার পাওয়ার এই যুদ্ধবাজ দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সহিংসতা লাগিয়ে রাখে কেবল নিজেদের স্বার্থে। তারা কারণে অকারণে বিভিন্ন দেশে হামলা করে। সাধারণ মানুষের প্রাণ নিয়ে তারা খেলায় মেতে উঠে। মানুষের প্রাণহানি হলে তারা উল্লাস করে।আবার বিভিন্ন দেশে মানবাধিকারের তাবিজও তারাই বিক্রি করে। তাদের স্বার্থে আঘাত হেনে কেউ সুস্থ থেকেছে- এমন নজির মেলা ভার। কিন্তু ইরান এবার দেখিয়ে দিল- সবাই এক নয়। সবাই মুখ বুজে মার খায় না। কেউ কেউ উল্টো মার দেয়। বলছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা।১৩ জুন ভোরে ইসরায়েল ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। পরে শনিবার ইরানের নাতাঞ্জ, ফর্দো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ১৭টি বাংকার–বিধ্বংসী বোমা ও দুই ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্যই এ হামলা চালানো হয়। মার্কিন হামলার পর ইরানের পাল্টা জবাব আসে। গত সোমবার সন্ধ্যায় তারা কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সেন্ট্রাল কমান্ড ঘাঁটি আল-উদেইদে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে।এ হামলায় ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কাতারের রাজধানী দোহার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা ছিল একেবারেই প্রত্যাশিত। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোর কয়েকটি ইরানের আশপাশেই অবস্থিত।আল-উদেইদ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে অবস্থিত। এ দুটির অবস্থান ইরান থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি দূরত্বে। এ ছাড়া সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি, ইরাকে তিনটি এবং কুয়েত ও জর্ডানে একটি করে মার্কিন বিমানঘাঁটি আছে। ওমানে চারটি লজিস্টিকস–সংক্রান্ত মার্কিন বিমানঘাঁটি আছে।ইরানে মার্কিন হামলার পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেন, এ হামলায় ভয়ানক প্রতিশোধের চক্র তৈরি হতে পারে। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। উল্টো হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এ যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছিল কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু মার্কিন ঘাঁটিতে এমন একটি হামলার পরও কীভাবে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলো? সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।আল–জাজিরার সাংবাদিক দোরসা জাব্বারি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি ঘাঁটিতে ৪০ হাজার সেনা রয়েছেন। ঘাঁটিগুলোর আটটি স্থায়ী। ইরান আগে থেকেই বলে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা চালায়, তবে এসব ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করা হবে।ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এক বিশ্লেষণে বলেছে, আগে যখন কেউ ইরানকে আঘাত করেছে, তখন তেহরান নিজেদের সেনা না পাঠিয়ে সমর্থক মিলিশিয়া গোষ্ঠী দিয়ে (যেমন ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ) প্রতিশোধ নিয়েছে। এটাই ছিল তাদের প্রধান কৌশল। সেই হিসেবে হুতি মিলিশিয়ারা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা চালাতে পারত কিংবা ইরান নিজেই হরমুজ প্রণালিতে জাহাজে হামলা করতে পারত। আর এমনটি ঘটলে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাণিজ্যিক নৌপথ হুমকির মুখে পড়ত। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো হামলা হয়নি। এটা ইঙ্গিত করে যে ইরানের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ বা এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স দুর্বল হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েক মাস ধরে চলা যুদ্ধের কারণে তারা ক্লান্ত।আইএসডব্লিউ তাদের ওয়েবসাইটে এমনটাই বলেছে। তবু পুরো বিশ্ব যখন ইরানের পক্ষ থেকে বড় প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিল, তখন সোমবার ব্রিটেনের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনসারি আল–জাজিরাকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটা পথ খোলা থাকতে পারে। বাহ্যিকভাবে অনেক হুমকি আসবে। কিন্তু পর্দার আড়ালে আলোচনা চলবে। স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় ইরান কাতারের দিকে হামলা চালায়।কাতার এ হামলাকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক ও কাতারের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানায় এবং দোহায় ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। তবে বিশেষজ্ঞ আনসারির বলা ‘পর্দার আড়ালের যোগাযোগ’ সম্ভবত আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তবে হামলা যে ইরান করবে সেটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। এ কারণে বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে বিমান এবং লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে ট্রাম্পের কথাতেই।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘আমাদের আগেভাগে জানানোয় ইরানকে ধন্যবাদ। এতে কোনো প্রাণহানি হয়নি, কেউ আহতও হননি।’ এই সতর্কতার ফলে কাতারও প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। তারা ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত করে এবং ১টি ক্ষেপণাস্ত্র ‘নিরাপদ’ পথে যেতে দেয়। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আগেই আল-উদেইদ ঘাঁটি থেকে বিমান ও কর্মীদের সরিয়ে নেয়। তাই হামলাটি প্রাণহানির দিক থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি বা কাতার বিমানবাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।হামলার তিন ঘণ্টা পর ট্রাম্প লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, কোনো মার্কিন নাগরিক আহত হননি। তেমন কোনো ক্ষতিও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তারা (ইরান) তাদের ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছে।’ এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, ‘সবাইকে অভিনন্দন! ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ট্রাম্প কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমি কাতারের অত্যন্ত সম্মানিত আমিরকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করেছেন।’ এখন প্রশ্ন হলো মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পরও ট্রাম্প কেন চুপ আছেন? তিনি পাল্টা হামলা না করে যুদ্ধবিরতিতে গেলেন? এই প্রশ্নের তিনটি উত্তর হতে পারে। প্রথমত, ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কিত। যুদ্ধ চলতে থাকলে ইসরায়েল এক সময় শেষ হয়ে যাবে। কারণ ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের দেশটিতে ব্যাপক হামলা শুরু করে ইরান। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি স্থাপনাতেও হামলা হয়। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। যুদ্ধ বন্ধের দাবি জোরালো হতে থাকে। বিপুল স্যংখক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন দেশে চলে যান।এই যুদ্ধ চলতে থাকলে গাজার মতো ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হতে ইসরায়েলের খুব একটা সময় লাগবে না। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প ইরানে হামলা চালিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যেটা উঠে এসেছে খামেনির বক্তব্যে। এ হামলায় ইরান পরমাণু চুক্তিতে যেতে বাধ্য হবেন বলে মনে করা হয়। ফলে হামলার পরও তিনি চুপ থেকেছেন। তৃতীয়ত, শান্তিতে নোবেল পাওয়ার আশা তো রয়েছেই। তিনি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন। অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে গেল। এ জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতেই পারেন। লেখক: সাংবাদিকভোরের আকাশ/এসএইচ
২ সপ্তাহ আগে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে মোটামুটি শান্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু কিছু দেশ, কিছু অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা যেন শেষ হওয়ার নয়। উদাহরণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে আছে যুগ যুগ ধরে। এর নেপথ্যে আছে সন্ত্রাসী ইসরায়েল এবং যুদ্ধবাজ আমেরিকা। বিধ্বংসী অস্ত্রের ধোঁয়া তুলে ইরাক আক্রমণ করেছিল আমেরিকা এবং তাদের মিত্ররা। কয়েক লাখ মানুষ হত্যার পর অবশ্য সেখানে বিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা সমালোচনার মুখে পড়লেও তাদের শাস্তি পেতে হয়নি।তালেবান সরকার উৎখাতের জন্য আফগানিস্তানে আমেরিকা এবং তাদের মিত্ররা কত মানুষ হত্যা করেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে আমেরিকার মদত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকার হটানোর নেপথ্যেও এই আমেরিকার হাত রয়েছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কেননা, সিরিয়ায় বহু বছর ধরেই বহুপক্ষীয় লড়াই চলছিল। এর মধ্যে মার্কিন সেনা, রুশ সেনা, তুর্কি সেনা এবং ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া ছিল। অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশে বহু আধিপত্যবাদী দেশ সেনা মোতায়েন করেছিল। সভ্যতার জন্য এটা ছিল বিশাল ক্ষত। এছাড়া আসাদ সরকারের সেনা এবং তাদের বিদ্রোহীরা তো ছিলই। এ কারণে বছরে পর বছর অগ্নিগর্ভ ছিল সিরিয়া। আসাদ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এছাড়া মাঝেমধ্যেই দেশটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতো সিরিয়ায়। এই ইসরায়েলের কারণেই তাদের প্রতিবেশীরা সব সময় তটস্থ থাকে। গাজায় তারা প্রতিনিয়ত মানুষ মারছে। কিছুদিন আগেও তারা লেবাননে হামলা করেছে। ইয়েমেনেও তারা হামলা করছে। কেবল জর্ডান ছাড়া প্রতিবেশী সব দেশকেই তারা শত্রু মনে করে এবং হামলা চালায়।ইসরায়েল এতকাল ইরানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল। অবশেষে ১৩ জুন রাতে তারা দেশটিতে হামলা চালায়। পাল্টা জবাব দেয় ইরান। ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে তেহরানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিশোধ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় তেহরান। কিন্তু এই হামলাকে ফ্রেন্ডলি হামলা বলা চলে। কেননা, হামলা করার আগেই ইরান সতর্ক করেছিল। ফলে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। অবশ্য মার্কিন হামলায় ইরানেরও তেমন ক্ষতি হয়নি। দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইরানে কয়েকটি গর্ত খুঁড়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে।ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে ২৪ জুন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ২৩ জুন রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘোষণা দেন। এই যুদ্ধবিরতি বিশ্বকে স্বস্তি দিয়েছে। এই যুদ্ধবিরতি এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েল তিন পক্ষকেই বিজয়ের দাবি করার সুযোগ এনে দিয়েছে।যুক্তরাষ্ট্র বলতে পারবে যে তারা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল করে দিয়েছে। ইসরায়েল দাবি করতে পারে তারা তেহরানকে যথেষ্টভাবে দুর্বল করেছে; আর ইরান গর্ব করে বলতে পারে তারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এবং পিছু হটেনি। আধুনিক যুদ্ধে দেশের ভেতরের জনমত গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর এই তিন দেশই এখন জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছে জয় তাদেরই হয়েছে।ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, এখন প্রতিটি পক্ষই নিজ নিজ বিজয়ের গল্প তৈরি করে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি এড়িয়ে গেছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারত পুরো অঞ্চলে, এমনকি বিশ্বব্যাপী।যুক্তরাষ্ট্রের অর্জনকৌশলগত : অনেক দিন ধরে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলা যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ কৌশল বদলায় গত শনিবার। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দস্যু’ বলে আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, যদি তেহরান শান্তির পথে না আসে, তবে পরবর্তী হামলা হবে আরও ভয়াবহ। ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে ওয়াশিংটন জানত, সংঘাত কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।ট্রাম্প বুঝতে পারেন, তেহরানের এমন একটা পথ দরকার, যাতে তারা উত্তেজনার পথ থেকে সরে আসতে পারে, আবার দেশের অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনও না হারায়। এ কারণেই ইরান কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর ট্রাম্প পাল্টা হামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইরানকে আগাম সতর্কতার জন্য ধন্যবাদ দেন।যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিজ দেশেই বোমা হামলার সমালোচনার মুখে পড়া ট্রাম্প এখন নিজেকে শান্তিদূতের ভূমিকায় তুলে ধরতে পারছেন। এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনা হারায়নি, নিজেদের সামরিক শক্তি দেখিয়েছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও দাবি করতে পারছে। এ যেন ট্রাম্পের জন্য কৃতিত্ব দাবির মোক্ষম সময় হয়ে উঠেছে।ইসরায়েলের আত্মগর্ব : যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত বিমান হামলার আগের সপ্তাহেই ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আকাশে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তারা ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় এবং তেহরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অর্জন যুক্তরাষ্ট্রের এই সংঘাতে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে পড়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে চালানো বিমান হামলা শুধু তেহরান নয়, পুরো বিশ্বকে এই বার্তা দিয়েছে যে ওয়াশিংটন নিরঙ্কুশভাবে তেলআবিবের পাশে আছে।ভূরাজনৈতিকভাবে এই অবস্থান ইসরায়েলের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করেছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও এর প্রভাব পড়বে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এটি এক বড় রাজনৈতিক লাভ এনে দিতে পারে। নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানে পরিচালিত সামরিক অভিযানের সব লক্ষ্য ইতিমধ্যে পূরণ হয়েছে।ইরানের প্রতিরোধ : যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে চালানো বিমান হামলা তেহরানকে এক জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। প্রতিশোধ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে; কিন্তু প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। একদিকে মুখ রক্ষা, অন্যদিকে উত্তেজনা থেকে সরে আসার পথ দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে হতো ইরানকে। দেশটি সে পথেই হেঁটেছে।ইরান আন্তর্জাতিকভাবে এমন এক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, যেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে, মাথা নিচু করেনি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার দেশের বিরুদ্ধে চালানো যুদ্ধ মূল লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গত সোমবার তিনি বলেন, ‘আমি বলছি না যে তারা কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। হ্যাঁ, কিছু ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু তারা আমাদের সব ধরনের সক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার বা অন্য যেকোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা অর্জন করতে পারেনি।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদন উপেক্ষা : মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বছরের শুরুতে বলেছিল, তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। আর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র গত সপ্তাহে রয়টার্সকে জানিয়েছে, সেই মূল্যায়ন এখনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরানে হামলা করল যুক্তরাষ্ট্র। এর মানে বন্ধু ইসরায়েলের পাশে থাকল যুক্তরাষ্ট্র।ইরানের পরিমিত প্রতিক্রিয়া: ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান কাতারে একটি মার্কিন বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। গত রোববার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকার-বিধ্বংসী বোমা হামলা চালায়। জবাবে ইরান ওই মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলার বিষয়ে অবগত কয়েকটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা যাতে না বৃদ্ধি পায়, সে হিসাব করে গত সোমবার রাতে ইরান মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। এটি ছিল একটি পরিমিত পদক্ষেপ। ইসরায়েল ও ইরানকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান ট্রাম্প। আর হোয়াইট হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যতক্ষণ না ইরান নতুন করে হামলা চালায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল ইসরায়েল।ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা আর কোনো হামলা চালাবে না। ট্রাম্প সরাসরি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন। আর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইরানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ করেছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।হোয়াইট হাউসের ওই কর্মকর্তা বলেন, ইরান নিজেদের ‘দুর্বল অবস্থার’ কারণে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। কয়েক দিন ধরে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা হয়েছে। দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করা হয়েছে। ট্রাম্প সম্প্রতি প্রকাশ্যে ইরানের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের জনস হপকিন্স স্কুল ফর অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ লরা ব্লুমেনফেল্ড বলেন, ট্রাম্প এখন ‘বিশ্বশান্তি’ ঘোষণা করেছেন। সুতরাং নেতানিয়াহুর জন্য এর বিরুদ্ধে যাওয়া কঠিন।ট্রাম্পের বড় জুয়া : দীর্ঘদিন ধরে বড় কোনো বিদেশি যুদ্ধে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সেই অঙ্গীকার ভুলে তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে ট্রাম্প বাজি ধরেছিলেন। তিনি ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো ধ্বংস করতে পারবেন এবং এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাম মাত্র প্রতিশোধ নেবে ইরান। যদি ট্রাম্প ইসরায়েল-ইরান সংঘাত প্রশমিত করতে পারেন, তাহলে তিনি কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার ঝড় কিছুটা শান্ত করতে পারবেন। এ ছাড়া নিজের দল রিপাবলিকানদের যুদ্ধবিরোধী অংশকেও সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন, যারা তার ইরানে বোমা হামলার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। এ ধরনের পদক্ষেপ ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী। অন্যদিকে সংঘাত বন্ধ করতে পারলে ট্রাম্প তার নীতিগত অগ্রাধিকারগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে পারবেন। এসব অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো এবং বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে শুল্ক যুদ্ধের মতো বিষয়। তবে ট্রাম্প ও তার সহকারীরা ইরান এবং এ-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করতে পারবেন না।রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় প্রশাসনের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মধ্যস্থতাকারী ডেনিস রস বলেন, ইরানিরা যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন অনুভব করছে। আর ইসরায়েল তাদের সামরিক লক্ষ্যের বেশির ভাগই পূরণ করে ফেলেছে। কিন্তু এখনো বাধা রয়ে গেছে। ইরান প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী? তাদের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের কী হবে? এগুলো নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হবে আর সেগুলো সহজে সমাধানযোগ্য নয়।লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষকভোরের আকাশ/জাআ
২ সপ্তাহ আগে
লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনেকটাই চাপমুক্ত হয়েছে সরকার। বলা চলে, কিছুদিন আগ থেকে সরকারের ভেতরে যে অস্থিরতা ছিলো; তা পুরোমাত্রায় কেটে গেল। সরকার এখন থেকে রুটিন ওয়ার্কসহ সংস্কার কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পাবেন। এতে আইন শৃঙ্খলা, কুটনীতিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ার আশা করা যায়।বলা যায়, লন্ডন বৈঠক সরকারের জন্য শতভাগ ইতিবাচক হয়েছে। একই সাথে দায় বাড়ে বিএনপির। সে দায় একই সাথে রাজনৈতিক, কুটনৈতিক এবং সামাজিক। দল হিসেবে বিএনপি যদি সমান্তরালে সে দায় পালনে দক্ষতার পরিচয় দিতে সামান্য ভুল করে, তাহলে রাজনীতির সমীকরণে অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে। যার আভাস ইতোমধ্যে সামনে আসতে শুরু করেছে।লন্ডন বৈঠকের পর স্বস্তি নিয়ে প্রফেসর ইউনূস দেশে ফিরেছেন। এর আগেই বৈঠকের কালচারকে ইতিহাসের নজিরবিহীন হিসেবে বক্তব্য দিয়েছে জুলাই বিপ্লব বা গণাভ্যুথ্থ্যানে সরাসরি অবদান রাখা এবং একই সাথে বিএনপির দীর্ঘ পরীক্ষিত মিত্র রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। তারা বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সরকার প্রধানের বৈঠক হতেই পারে। কিন্তু সেই বৈঠকের বিষয়বস্তু যৌথ ঘোষণা আকারে আসা ইতিহাসের নজিরবিহীন। এতে সরকার একটি পক্ষের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। যা সামনের দিনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে আকাঙ্খা তা বাস্তবায়নে সংশয় সৃষ্টি হতে বাধ্য। একই বার্তা দিয়েছে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এনসিপি। তারা বলেছে, এতে সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক হওয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু জাতীয় ইস্যুতে কোন সিদ্ধান্ত হতে হলে সরকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই হতে হবে। আর জুলাই আন্দোলনের যে আকাঙ্খা তাকে পাশ কাটিয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোও একই প্রকার বার্তা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণও একই প্রকার কথা বার্তা বলছেন।লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার প্রধান বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর করতে চেয়েছেন। সে কারণে আগের অবস্থান থেকে অনেক ছাড় দিয়ে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময় যেমন উঠেছে, একইসঙ্গে অর্থনীতি সামাল দেওয়াসহ দেশ পরিচালনায় দুর্বলতা এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে।চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার চিন্তা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের জন্য মানবিক করিডরের প্রশ্নসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তি সরকারকে অস্থিরতায় ফেলেছিল বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কিন্তু সরকার যদি রাজনৈতিক শক্তিসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে তিক্ততায় যায় এবং একটা অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই সরকারের ‘এক্সিট’ নিয়েও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশংকা থাকে। সেক্ষেত্রে সরকারের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া এবং পরে নিরাপত্তার প্রশ্নে বন্দোবস্ত কী হবে, সেটিই বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে সরকারের বিবেচনার বড় বিষয় ছিল। যার একটি গ্যারান্টি কোলাজ পেয়েছে সরকার।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা হাফিজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। এপ্রিলের মধ্যে ভোট হবে তার এমন ঘোষণায় তিনি অনড় আছেন। বিএনপির সঙ্গে সরকারের যে টানাপোড়েন ছিল সেটির অবসান হয়েছে যা ছিল এ বৈঠকের বিশেষ বার্তা। তবে বৈঠকে সংস্কার ও বিচারসহ নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান অস্পষ্ট। এছাড়া বিএনপি যে ঐক্যের কথা বলছে সেখানেও কিছুটা হলেও অনৈক্য তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজনীতির মাঠে এই যে অসন্তুষ্টি বা অনৈক্য তৈরী হলো তা সমাধান করে একটি সুষ্ঠুু ও গ্রহণ যোগ্য নির্বাচনের দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়ার দায়তো বিএনপির ঘাড়ে গিয়ে বর্তালো। কারণ সরকার কোন ভাবেই রাজনৈতিক আবেগ মিটিয়ে ফেলার কাজে মনোযোগ দিবে না বা দায় নিবে না।দল হিসেবে বিএনপি কোন কৌশলে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক শক্তিকে আস্থায় এনে সামনের নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে তা একান্তই তাদের ব্যাপার হযে দাঁড়ালো। আবার জুলাই সনদ ঘিরে যে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে তাতেও এখন বিএনপির স্পষ্ঠ অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আবার দেশকে অস্থিতিশীল করে যে দেশীয় বা বহিশক্তি সুবিধা নিতে চায়, তাদের ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত যে থেমে যাবে তাওতো নয়।কুটনৈতিক অঙ্গনে যদি এমন বার্তা যায় যে, দেশে রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে নির্বাচন দেয়া যাচ্ছে না। তাহলে কাঙ্খিত নির্বাচনের ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যাবে। সব মিলে ঘরে এবং বাইরে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে সকলের আস্থা সৃষ্টির মোটা দাগের দায়টি লন্ডন বেঠকে কাঁধে তুলে নিয়েছে বিএনপি। এখন দেখার বিষয় রাজনৈতিক আস্থা সৃষ্টিতে বিএনপি কতটা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।ভোরের আকাশ/জাআ
৩ সপ্তাহ আগে