ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৫ ০৯:১৪ এএম
ছবি: সংগৃহীত
গতকাল মঙ্গলবার ছিল পহেলা জুলাই। এক বছর আগে এদিনটিতেই সূচনা হয়েছিল জুলাই গণ অভ্যুত্থানের। জুলাইয়ের শুরুতেই গতকাল মঙ্গলবার সকল শহীদ ও আহতসহ অভ্যুত্থান বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে পুরো দেশবাসী। নানা কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়। বিতরণ করা হয় জুলাই ক্যালেন্ডার এবং সূচনা করা হয় জুলাই হত্যাকাণ্ডের খুনিদের বিচারের দাবিতে গণ-স্বাক্ষর কর্মসূচির। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত মাঝে মধ্যে বিরতি দিয়ে এ অনুষ্ঠান হবে। বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ঘোষণা করেছে মাসব্যাপী কর্মসূচি।
পহেলা জুলাই উপলক্ষে পালিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তারা বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড়, যা জনগণের বিক্ষোভ, দাবিদাওয়া ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিদায়ের ক্ষণ শুরু হয়েছিল।
এই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ফিরে দেখা যায় সেই উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপট, দাবি-দাওয়া, আন্দোলনের ধরন এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক জবাবদিহিতার প্রশ্নে এই ঘটনা দেশে ও বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
মুজিববাদী সংবিধান ফেলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে : আখতার হোসেন
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, যারা গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং বাংলাদেশের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ চাপিয়ে দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের পুরোনো যে সংবিধান এই মুজিববাদী সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন এক সংবিধান প্রণয়ন করতে গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর জাফরপাড়া গ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের পর তিনি এ কথা বলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার থেকে এনসিপির আয়োজনে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে এ কর্মসূচি শুরু হয়। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
আখতার হোসেন বলেন, আবু সাঈদ আমাদের দ্রোহের প্রতীক। তার কবরের পাশ থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি। আমরা আবু সাঈদের কবর ছুঁয়ে শপথ করছি— যতক্ষণ না নতুন বন্দোবস্তের ভিত্তিতে, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গঠিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধানের দাবিতে দেশ গড়ার জুলাই পদযাত্রার সূচনা আমরা করলাম শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে। হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তদানের মধ্য দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করেছি। এজন্য অবশ্যই পুরনো কাঠামো ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত নির্মাণ করতে হবে, মৌলিক সংস্কার আনতে হবে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় দরটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, দক্ষিণাঞ্চল মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, উত্তরাঞ্চল মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিন, যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা, যুগ্ম-মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) মাহমুদা মিতু সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন। কবর জিয়ারত শেষে এনসিপির নেতারা শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের খোঁজখবর নেন। এ সময় আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক দফার ঘোষক ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে দোয়া করেন।
আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম ও বাবা মকবুল হোসেন অশ্রুসজল ছিলেন। এমন হৃদয়বিদারক পরিবেশে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি এনসিপিরনেতারাও। তারা আবু সাঈদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। একইসঙ্গে এনসিপির সারা দেশব্যাপী জুলাই পদযাত্রার মাধ্যমে আবু সাঈদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিএনপি ধরে নিয়েছে ক্ষমতায় যাবে, আগের মতো অপকর্ম করবে : ডা. তাহের
জামায়াতে ইসলামী সংস্কারবিহীন নির্বাচন গ্রহণ করবে না জানিয়ে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘বিএনপি ধরে নিয়েছে এবার তারাই ক্ষমতায় যাবে আর ক্ষমতায় গিয়ে আগের মতো অপকর্ম করবে।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব এমন এক ঐক্য তৈরি করেছে, যেখানে ভিন্ন আদর্শের দলগুলোও এক মঞ্চে এসেছে। জনগণ এখন অনেক বেশি সচেতন। স্বৈরাচারী মানসিকতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি, তবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে সেই শক্তিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা হবে।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর পল্টনে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্মরণে দোয়া অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে দেশের মানুষ আবারও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকবে। সংস্কারবিহীন কোনো নির্বাচন জামায়াতে ইসলামী গ্রহণ করবে না।’
তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে জনগণ যাকে ভোট দেবে, তারাই নির্বাচিত হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে, না হলে দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, যা জনগণ মেনে নেবে না।’
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান না হওয়ায় কেউ কেউ জুলাইয়ের সফলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তবে আমাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল এক মহান অর্জন, একটি স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় জানানো এবং মানুষকে মুক্ত করা। জুলাই ব্যর্থ হয়েছে এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।’
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের বিষয়ে দুটি দল বাদে বাকি সব দলই ঐকমত্যে পৌঁছেছে।’
জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না : মান্না
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে যে অর্জন হয়েছে, তা যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনমূলক ভূমিকা জরুরি।’
তিনি বলেন, দেশের রাজনীতিতে নতুন এক সংস্কৃতি হিসেবে উঠে এসেছে আলোচনা এবং ঐকমত্যের চেষ্টা- আর এই ধারাকে ধরে রেখে দেশের ‘ভবিষ্যৎ গঠনমূলক সংস্কার’ এগিয়ে নিতে চান । তিনি বলেছেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে যতদূর ঐকমত্য হবে, ততদূর সংস্কার হবে। বাকি সংস্কার পরবর্তীতে।’
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জনআকাক্সক্ষা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মান্না এসব কথা বলেন। গণশক্তি সভা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ একটি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন চায়। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হলেও অনেক বিষয়ে এখনও মতানৈক্য রয়ে গেছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নিয়মিত আলাপ-আলোচনার যে অভ্যাস ছিল না, এখন তা তৈরি হচ্ছে। এ সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। কার্যকর গণতন্ত্র চর্চার জন্য এটাই পথ।’
সভাটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক ও গণশক্তি সভার সভাপতি সাদেক রহমান। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন— বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন, নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিব আনোয়ার, বাংলাদেশ জনতার পার্টির চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ নূর এবং নাগরিক নারী ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসী আক্তার।
দল বা ব্যক্তি নয়, জুলাই ঘোষণাপত্র দেবে অন্তর্বর্তী সরকার : জুলাই ঐক্য
জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ সরকারকেই দিতে হবে। কোনো দল বা ব্যক্তি এখন আর জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না।এমনই মন্তব্য করেছে গণ-অভ্যুত্থানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্ল্যাটফর্ম জুলাই ঐক্য। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘মার্চ ফর জুলাই রিভাইভস’ কর্মসূচি শেষে এ মন্তব্য করেন প্ল্যাটফর্মটির নেতারা। জুলাই ঐক্যের সংগঠক এবি জুবায়ের বলেন, ১১ মাসেও আমরা জুলাই সনদ পাইনি। কোনো একক দলের জুলাই সনদ দেওয়ার এখতিয়ার নাই। এই সরকারকেই জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে হবে। সরকার যদি ব্যর্থ হয় তাহলে উচিত হবে, দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। তা না হলে জুলাইয়ের ছাত্রজনতা আদায় করে নেবে। কোনো ব্যক্তি বা দল যদি জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে চায়, তাহলে ছাত্রজনতা তা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করবে।
প্ল্যাটফর্মটির অপর সংগঠক মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি। অবিলম্ব জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে হবে। জুলাই যোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্র না দিলে ৫০ বছর পর জুলাইয়ের এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দেওয়া হবে। তাই সরকারকে বলব অবিলম্বে কালক্ষেপণ না করে জুলাই ঘোষণাপত্র দিন।
আরেক সংগঠক ইসরাফিল ফরাজী বলেন, গত ১১ মাসে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দুজন ছাত্র উপদেষ্টা তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও গণমাধ্যমে কোনো সংস্কার হয়নি। সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারের কোনো জায়গায় সংস্কার হয়নি। এনবিআর থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে রেখেছে ফ্যাসিবাদের দোসররা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ