আদমদীঘি (বগুড়া) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৫ ০৪:৫৭ পিএম
ধানের দামে হতাশ আদমদীঘির কৃষকরা
খাদ্যশষ্যের ভাণ্ডার খ্যাত পরিচিত উত্তরের জেলা বগুড়া। আদমদীঘিতে এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও দাম কম হওয়ায় কৃষকরা রয়েছে চরম দূশ্চিন্তায়। চলতি ইরি-বোরো মৌসুম ছিল কৃষকদের জন্য সর্বোচ্চ খরচের বছর। সেচযন্ত্রের জ্বালানি ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম ছিল রেকর্ড পর্যায়ে। এবারে খরার কারণে সেচও লেগেছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে সার, কীটনাশক সহ শ্রমিকের মজুরি। অথচ সীমাহীন খরচের এই মৌসুম শেষে ধানের কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না কৃষক। দিন দিন কমেই চলেছে ধানের দাম। ভরা মৌসুমেও হাটবাজারে ধানের কাঙ্খিত দাম না পেয়ে হতাশ এই এলাকার কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌসভায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষকরা প্রধানত: জিরাশাইল, পারিজা, সুবর্ণলতা, সুমনলতা, কাটারি, চিনি আতপ এবং হাইব্রীডসহ দেশীয় জাতের ধান আবাদ করেছে।
কৃষকদের অভিযোগ, চলতি মৌসুমে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও অধিক সার কীটনাশক ব্যবহার এবং ধানকাটা শ্রমিকের মজুরি দ্বিগুণ হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া খরার কারণে সেচও লেগেছে বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি। সেই ব্যয় অনুযায়ী বাজারে ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না তারা। বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১০ থেকে ১১ হাজার টাকার মধ্যে, যা এবছর সেচ, সার, কীটনাশক ও মজুরি বাড়ায় দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। এর মধ্যে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ খরচ বেড়েছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সারের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া বীজ ও কীটনাশক কিনতে হয়েছে চড়া দামে। ধান পরিচর্যা, কাটা শ্রমিকের মজুরি, মাড়াই ও পরিবহনসহ অন্য সব ধরনের খরচও বাড়তি। কয়েক দফায় সবকিছুর দাম বাড়লেও ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। ধান বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে।
চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো ধান কাটার শুরুতে ধানের দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায় ছিল। কিন্তু এলাকার ফরিয়া ধান ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারদের সিন্ডিকেটের কারণে প্রতি দিন ধানের দাম মণ প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা হারে কমছে। এতে করে উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে দাবি কৃষকদের।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এবছর প্রতি মণ বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৫০ টাকার বেশি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে এলাকাভেদে সরু জাতের ধানের দাম ১ হাজার ১শ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ দামে ধান বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না বলে দাবি কৃষকের।
সরেজমিনে উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম, সান্তাহার, শাঁওইল এবং আদমদীঘি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত হাটের চেয়ে ধানের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। গত হাটে জিরার ধান বিক্রি হয়েছে ১৩শ’ থেকে সাড়ে ১৪শ’ টাকায়। বাজারে ওই ধান এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কমে। আর কাটারির বাজার দর ১০০ টাকা কমে ১ হাজার থেকে সাড়ে ১শ’ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এদিকে চিনি আতপ জাতের ধানের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। হাইব্রীড ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৯শ’ টাকায়।
সকাল থেকেই শুরু হয় কেনাবেচা ছাতিয়ানগ্রাম হাটে। সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার বসে হাট। ধান বেচাকেনা চলে দুপুর পর্যন্ত। তবে, অন্যান্য দিনেও ধান বিক্রি হয় এই হাটে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় ব্যাপারীরা ধান কম কিনছেন।
মিলন নামের স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, গত কয়েক দিনের বর্ষায় ধানের রং এবং মান দুটোই পাল্টেছে। অনেক ধানের পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। আবার অনেক ধানের চারা (ট্যাক) গজিয়েছে। এসব ধান কিনলে আমরা গোডাউনে রাখতে পারবো না। পচে যাবে। তাই দেখেশুনে ভাল ধান না হলে; ক্রয় করছি না। তবে গত সপ্তাহের চেয়ে মানভেদে ধানের দাম কমেছে ২শ’ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত।
আলমগীর নামের আরেক ধানব্যবসায়ী বলেন, রোদ না থাকায় ধানের কালার পরিবর্তন হয়েছে। এসব ধান কিনলেও পরে কম দামে বিক্রি করতে হবে। আবার অনেক ধান নষ্ট হবে। এজন্য ধানের দাম কম। তবে, শুকনো ধানের দাম তুলনামূলক পরিবর্তন হয়নি।
অন্তাহার গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দীন অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট জোরালো থাকায় আমরা ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কমিয়ে দিয়েছে ধানের দাম। পাশাপাশি মিল মালিকরা ধান মজুত করছে। এতে তাদের লাভ হলেও ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা (কৃষকরা)।
তবে হাটের পাইকার ও ব্যবসায়ীদের দাবি, ‘আবহাওয়া খারাপ। বাজারে ধানের আমদানি বেশি। ভেজা ধান কিছুটা কম হলেও, মোটা ও চিকন শুকনো ধান বেশি দাম দিয়ে কিনেছি।
সদরের শিয়ালসন গ্রামের কৃষক শফিক মিয়া জানান, এবছর ৬ বিঘা জমিতে ইরি ধান আবাদ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ২১ মণ করে ফলন পেয়েছি। এক বিঘা জমিতে ধান চাষে পানি, কীটনাশক, শ্রমিক বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। এতে ধান আবাদ করে আমি তেমন লাভবান হতে পারবোনা।
আদমদীঘি নির্বাহী অফিসার নিশাত আনজুম অন্যনা বলেন, এ উপজেলায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। ধানের ফলনও বেশ ভালোই। নতুন ধান কাটা মূহুর্তে ধানের দাম কিছুটা বেশি ছিল। তবে কি কারণে ধানের দাম কমছে তা সরজমিনে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।
ভোররে আকাশ/এসআই