তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৫ ০৯:০৫ এএম
ছবি: সংগৃহীত
পর্বতসম খেলাপি ঋণের জেরে বড় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। যে হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সেই হারে মুনাফা করতে না পারায় দুর্বল-সবল মিলিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি। এই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় গুণ বেশি যা দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বল ভিত্তি নির্দেশ করছে।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, বিতরণকৃত প্রতিটি ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। ব্যাংক প্রতিবছর যে পরিচালন মুনাফা করে সেখান থেকে প্রভিশন রাখতে হয়। পরিচালন মুনাফা থেকে প্রভিশন রাখা ও কর্পোরেট ট্যাক্স পরিশোধের পর নিট মুনাফা প্রকাশ করে ব্যাংক।
প্রভিশন সংরক্ষণের মাধ্যমে মূলত সঞ্চয়কারীদের আমানতের নিরাপত্তা বিধান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্ত সঞ্চিতি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ আরও ঝুঁকিতে পড়ছে। এই তালিকায় দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি কিছু সবল ব্যাংকও রয়েছে। তারা নিট বা প্রকৃত মুনাফা বেশি দেখাতে গিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে কম।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো প্রতি বছর যে পরিচালন মুনাফা করে সেখান থেকে সাধারণ ক্যাটাগরির বা ভালো মানের ঋণের বিপরীতে ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। বিতরণকৃত ঋণের ঝুঁকির ওপর প্রভিশনের হার বাড়ে-কমে।
এছাড়া যেসব ঋণ নিম্নমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হয় সেগুলোর বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাখতে হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং করার বিধান রয়েছে। এসব ঋণ ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকায় শতভাগ প্রভিশন রাখার নিয়ম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রভিশন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথমত যাতে আমানতকারীদের সঞ্চয় নিরাপদ থাকে। পাশাপাশি খারাপ ঋণ দিয়েও যাতে ব্যাংকের মালিকপক্ষ মুনাফা তুলে নিতে না পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো নানা অজুহাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি না রেখে পার পেয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি পরে রাখা হবে (ডেফার্ড সুবিধা) এই অজুহাত দিয়ে নিট মুনাফা বেশি দেখিয়ে ডিভিডেন্ড নিচ্ছেন কিছু ভালো ব্যাংকের মালিকরাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ টাকা। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৬৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। তারও আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা।
এছাড়াও গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে প্রভিশন ঘাটতি ছিল মাত্র ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। যা এক বছরের বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় গুণ। তথ্য বলছে, মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। তারও আগে গতবছরের সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা।
তথ্যানুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুরোর প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫৮ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা বা দ্বিগুণেরও বেশি। তারও আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। তবে বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন উদ্বৃত্ত রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি উদ্বৃত্ত রয়েছে ৪৩২ কোটি টাকাও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রবিশন উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৪৮ কোটি টাকা।
এদিকে ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যা তৎকালীন বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক ভোরের আকাশ’কে বলেন, প্রভিশন হলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে রক্ষাকবচ। ব্যাংক নিজের অর্থ ঋণ দেয় না। সঞ্চয়কারীরা যে আমানত রাখেন সেখান থেকেই ঋণ বিতরণ করে থাকে। তাই যেসব ব্যাংক বছরের পর বছর ধরে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখছে না তাদের ঋণ কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করে দেওয়ার পরামর্শ দেন মাজেদুল হক।
প্রভিশন ঘাটতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, মূলত তিনটি কারণে প্রভিশন ঘাটতি হতে পারে। যখন ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন ব্যাংক সেই ঋণের জন্য প্রভিশন রাখে। যদি প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ প্রভিশনের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ঘাটতি দেখা দেয়।
এছাড়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ভবিষ্যত ঝুঁকির জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠন না করে, তাহলে প্রভিশন ঘাটতি হতে পারে। পাশাপাশি যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণের ঝুঁকি সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে বা প্রভিশন কম ধরে, তাহলেও ঘাটতি তৈরি হয়। প্রভিশন ঘাটতির ফলে ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা কমে যায় বলে জানান মাজেদুল হক। এ পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসতে নিয়মিত ঋণের মান মূল্যায়ন করা সহ ঋণ আদায়ের কঠোর নীতি প্রয়োগ করার পরামর্শ এই বিশ্লেষকের।
ভোরের আকাশ/এসএইচ