নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১১:১৮ পিএম
ছবি সংগ্রহীত
নারায়ণগঞ্জে আত্মহত্যা এখন এক নীরব মহামারীর রূপ নিয়েছে। কখনও পারিবারিক কলহে, কখনও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, আবার কখনও আর্থিক দুঃসহতায়—প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে আত্মহত্যার করুণ ঘটনা।
গত ১১ অক্টোবর সোনারগাঁওয়ে ঘটে আরেক হৃদয়বিদারক পরিণতি। পাঁচ বছরের নিষ্পাপ শিশু রোহানকে বিষ খাইয়ে মা মিতু বেগম নিজেও বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। একই দিন একই উপজেলার আরও একটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীসহ চারজনের আত্মহত্যার খবর পায় পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানা ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে জেলায় আত্মহত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত এক হাজার ৩৬৫ জন মানুষ।
সংখ্যার ভয়াবহতা বোঝা যায় পরিসংখ্যানেই। ২০২১ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ২৩৮ জন, ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৪ জনে। ২০২৩ সালে কিছুটা কমে ২৮৪ হলেও ২০২৪ সালে আবারও বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৪ জনে। আর চলতি ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ২৪৫ জন। এই ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে, তবে বছর শেষে সংখ্যা পেরিয়ে যাবে গত বছরের রেকর্ডও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আত্মহত্যার নেপথ্যে রয়েছে বহুমুখী সামাজিক ও মানসিক কারণ। পরকীয়া প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, মাদকাসক্তি, যৌতুকের চাপ, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ ও প্রতারণা—সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আকাশ সংস্কৃতি’ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত প্রভাবও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে।
আত্মহত্যা রোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী বা এনজিওর পক্ষ থেকেও সচেতনতামূলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কিংবা কাউন্সেলিং আয়োজনের নজির নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে জেলার বিভিন্ন থানায় আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।
জেলার সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে বন্দরে, দ্বিতীয় স্থানে রূপগঞ্জ, আর তৃতীয় অবস্থানে সোনারগাঁও। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল বউবাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে একই পরিবারের তিনজন স্বামী, স্ত্রী ও চার বছরের শিশু সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, গৃহকর্তা শিপলু এক সমিতিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। করোনাকালে গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা ফেরত না দিতে পারায় তাঁর নামে মামলা হয়। সেই আর্থিক চাপ ও সামাজিক লজ্জা থেকেই তিনি হয়তো স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন।
একশনএইডের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার উৎসব বৈরাগী বলেন, “আত্মহত্যা রোধ করা তো যাচ্ছেই না, বরং ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সমাজের ভেতরে যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেটিই মানুষকে আত্মবিনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
নারায়ণগঞ্জ জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল বাশার রুবেল বলেন, “যেসব ঘটনায় আত্মহত্যা হচ্ছে, সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও দায় নির্ধারণ হলে অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা দেখি, অধিকাংশ আত্মহত্যাই তদন্তহীন থেকে যায়।”
সোনারগাঁওয়ের গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন বলেন, “এ থেকে উত্তরণের দুটি পথ রয়েছে—প্রথমত পারিবারিক বন্ধন অটুট করা, দ্বিতীয়ত জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম ও সমাজের সুধীজনদের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এখন পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, মানসিক যোগাযোগ কমছে—এটাই মূল সমস্যা।”
জরিপের তথ্য বলছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে অধিকাংশই মান-অভিমান ও মানসিক আঘাত থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়। পারিবারিক কলহে ৩.১৪ শতাংশ, হতাশা থেকে ২ শতাংশ, মানসিক সমস্যার কারণে ১.৮ শতাংশ, আর্থিক সংকটে ৩.৮ শতাংশ এবং যৌন হয়রানি বা উত্যক্তের শিকার হয়ে ৩.১৩ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছে। অনেকে আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য ছড়িয়ে পড়ার পর চরম লজ্জা ও মানসিক চাপে এই পথ বেছে নেয়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার। গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জে ২৭৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র। আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রেমঘটিত ব্যর্থতা ও আর্থিক সংকটে বেশি আত্মহত্যা করছে। আর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ পারিবারিক মান-অভিমান। এই বয়সী তরুণ-তরুণীদের মানসিক সহনশীলতা গড়ে তোলা জরুরি।”
জরিপে আরও দেখা গেছে, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় তিনজন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে দুজন, মোবাইল বা মোটরসাইকেল না কিনে দেওয়ায় যথাক্রমে দুই ও একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনার পেছনে পারিবারিক অবহেলা ও সামাজিক চাপই মূল কারণ।
কাঞ্চন সলিমউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফারজানা আহম্মেদ বলেন, “আত্মহত্যা প্রতিরোধে গণসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। মিডিয়ায় ইতিবাচক প্রচারণা, স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং ও পরিবারভিত্তিক শিক্ষা দরকার। পাশাপাশি যৌতুক, বাল্যবিবাহ ও সামাজিক অবিচারের মতো বিষয়গুলোতেও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। মানুষকে নিরাপত্তা ও আশা দিতে না পারলে আত্মহত্যা থামানো যাবে না।”
রূপগঞ্জ থানার ওসি তারিকুল ইসলাম বলেন, “সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। এটিকে প্রতিরোধ করা সমাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু পুলিশ বা প্রশাসন নয়, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, “মূল সমস্যা সামাজিক ও পারিবারিক। এখন পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন—সবাইকে একত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবারে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ফিরিয়ে আনাই পারে এই ভয়াবহ প্রবণতা রুখে দিতে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা নয়—এটি এখন এক সামাজিক বিপর্যয়। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মাদকাসক্তি ও সামাজিক অনিরাপত্তা মিলে একটি মানসিক অস্থির সমাজ তৈরি করছে, যেখানে জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আশার আলো।
নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি থানা থেকে এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আত্মহত্যার খবর আসে—কখনও কোনো তরুণীর, কখনও কোনো পরিবারের। কিন্তু সমাজ তখনও নির্বিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি সচেতনতা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক পুনর্গঠনের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে এই নীরব মহামারী আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ভোরের আকাশ//হ.র