হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। গত বছরের জুলাই আন্দোলনে হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ষড়যন্ত্রসহ ৫টি অভিযোগ গঠনের জন্য এ শুনানি হচ্ছে। গত ১ জুন তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় ১১ মাস পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হলো। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য তিনি যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন; সেই ট্রাইব্যুনালেই তার বিচার হচ্ছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুনানি হচ্ছে।ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় গ্রেপ্তার আছেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে মো. আমির হোসেনকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে রাষ্ট্র।১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ মামলার ১৩৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। পরে অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে ট্রাইব্যুনাল।এ মামলায় আরেক অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ১৬ জুন অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তার সূচনা বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।’হত্যা, ষড়যন্ত্রের পাঁচ অভিযোগ : জুলাই-আগস্টে ১৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষ আহত করা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। নিহতদের তালিকা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া অডিও, ভিডিও, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনও দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। এ মামলায় ৮১ জন সাক্ষ্য দেবেন বলে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম। এই তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, সহায়তা, প্ররোচনা, উস্কানি, সম্পৃক্ততার পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। পাঁচ অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে মোট ১৩ জনকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, গত বছরের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা, নাতি-পুতি বলে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর আক্রমনের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতনে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, এটি আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত অপরাধ।শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদকে লক্ষ্য করে বিনা উস্কানিতে হত্যা, রাজধানীর চাঁনখার পুলে ছয়জনকে হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া সরকার পতনের দিন পাঁচই অগাস্ট আশুলিয়ায় পাঁচজনকে গুলি করে হত্যার পর তার মরদেহ এবং জীবিত একজনকেও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে ২৭টি। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। এখনো পলাতক ১৩২ জন। আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে মারা গেছেন একজন।গ্রেপ্তারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যারা : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য আছেন ১৭ জন। তারা হলেন আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ ফারুক খান, শাজাহান খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামরুল ইসলাম, শামসুল হক, আতিকুল ইসলাম, কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনাইদ আহমেদ পলক ও এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী। সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক সদস্যদের মধ্যে অন্তত ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল, পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক সহকারী কমিশনার জাবেদ ইকবাল, রাঙামাটি ট্রেনিং সেন্টারের সাবেক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা, মিরপুর বিভাগের সাবেক এডিসি মইনুল ইসলাম, বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, সাবেক এসি তানজিল আহমেদ, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল ইসলাম, উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক ওসি মো. মুজিবুর রহমান, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন, সাবেক উপপরিদর্শক চঞ্চল চন্দ্র সরকার ও মালেক, সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ইমাজ হোসেন, মো. নাসিরুল ইসলাম, মো. সুজন হোসেন, মুকুল চোকদার, হোসেন আলী ও মো. আকরাম হোসেন।এ ছাড়া সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো. শাহিনুর মিয়া, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. বশির উদ্দিন, ঢাকা মহানগর উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী প্রমুখ গ্রেপ্তার হয়েছেন।ভোরের আকাশ/এসএইচ